৭
‘মৃত্যু সে তো ক্রীড়নক মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের
সদনে/ সে মৃত্যু নাচিছে আজ ক্রীড়কের সুত্র আকর্ষণে
/তরুণের তাজা রক্তে স্নাত হয়ে জেগেছে তরুণ /জয়হীন বাধাহীন অচঞ্চল প্রদীপ্ত অরুণ।’
কে আবৃত্তি করছে! তেজদৃপ্ত কণ্ঠে শব্দগুলি ভেসে আসছে মেঘমন্দ্রিত উচ্চারণে ।
যেন গনগণে আঁচ।রামচন্দ্রপুরের সাহিত্য আড্ডায় এরকম কত মানুষই তো আসে তাঁদের সবার সাথে পরিচয় হয়ে ওঠে না।
কিন্তু এই মানুষটির গলার ভেতর যেন বিদ্যুতের ঝিলিক।মাইকের সহায়তা ছাড়াই দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে তার প্রতিটি শব্দের অনুরণন।
পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বাবা।
এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা।এর আগে কি এই তেজদৃপ্ত পুরুষের সাথে
দেখা হয়েছে কখনও ? অথচ মনে হচ্ছে কত যুগের ওপার থেকে তার
স্নেহময় দৃষ্টি যেন ছুঁয়ে আছে তাকে।
অন্নদাপ্রসাদ বসে রয়েছেন আড্ডার মধ্যমণি ।তিনিও একটি কবিতা পড়লেন – বর্ষার মাঝে বজ্রের মাঝে ঝঞ্ঝার
মাঝে জাগ/ বুকে বুকে প্রলয়ঙ্কর প্রলয় করহ আজি/ নব সৃষ্টির নব আয়োজনে হে রুদ্র এসো সাজি।
কবিতার মগ্নতা ভেঙে অন্নদাপ্রসাদ তাকালেন বাবার
দিকে- কখন এসেছিস ?
-
এই তো , এইমাত্র। কবিতা শুনছিলাম
আপনাদের।
তুই এসেছিস।
আগে বলিস নি কেন ।আরও অনেকের সাথে পরিচয় হত।তাঁরা তো চলে গেল সব। বাবা তাকিয়েছিল
ধ্যানগম্ভীর সেই মানুষটির দিকে। চেনা চেনা
মনে হচ্ছে।বয়স কত দেখে
বোঝা যাচ্ছে না।চেহারায় এক অপূর্ব দীপ্তি যেন সময়ের সমস্ত হিসেব নিকেশ স্থবির করে দিয়েছে।
গলার স্বর যেন স্পষ্ট ও তেজস্বী ।
বহুকাল আগে তাঁকে যেন দেখেছে কোথাও।
কিন্তু কোথায় ? তা মনে পড়ছে না কিছুতেই।
চিনিস এঁকে ?
বাবার নীরবতা দেখে একটু অবাক হলেন অন্নদাপ্রসাদ।
এই নীরবতা মুগ্ধতার তা অনুমান করেই বললেন – চিনিস না ?কবিতা লিখলে স্বজনদের তো চিনতেই হবে।আর চিনতে হবে সাহিত্যের নামে ভড়ং করা অভিনেতাদের।
যারা একটা লাইনও লেখেনা অথচ দেখে মনে হবে এরা যেন বাংলা সাহিত্যকে
উদ্ধার করার অবতার এসেছেন।
অন্নদাপ্রসাদ সাধারণত এরকম বিতর্কিত কথা বলেন না।
কিন্তু আজ বলছেন । কেন বলছেন
তা বোঝার চেষ্টা না করে বাবা তাকিয়ে আছেন মানুষটির দিকে।
অন্নদাপ্রসাদ পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন মানুষটির সাথে- একজন সত্যিকারের বিপ্লবী আত্মত্যাগী এই মানুষটি আমার খুব কাছের বন্ধু।
বিয়ে করেন নি, সংসার করেন নি।
দেশের সেবার জন্য উৎসর্গ নিজের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত।দেশসেবার পাশাপাশি সাহিত্যের এক অক্লান্ত সাধক।
সেই কবে থেকে পরিচয়। প্রায় তিন
দশের বেশি। আত্মকেন্দ্রিক পৃথিবীতে এরকম পাগল
মানুষ দুর্লভ ।আজন্ম বিপ্লবী। কবিতায় শুধু নয় জীবনেও।
জীবনের প্রতিটি কাজে।
অতীতের দিকে
চলে যাচ্ছিল অন্নদাপ্রসাদের দৃষ্টি ।শিল্পাশ্রমে নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের
কাছেই প্রথম দেখা।
তারপর কীভাবে গভীর গভীর হল ভালোবাসা ।
তার প্রতিটি পদক্ষেপ তুলে আনছেন তিনি।
বাবা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল কথাগুলি। অন্নদাপ্রসাদ
বলে যাচ্ছিলেন সেই রক্তঝরা ইতিহাস। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের
বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে জেল
হয়েছিল দুজনেরই। সেখানেই বন্ধুত্ব।
সংগঠন আর সংকল্পের যুগলবন্দী ।
কবিতার ভেতর দিয়েই তাঁদের আত্মিক বন্ধন।১৯২৮ সালে যখন রামচন্দ্রপুরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে মানভুম রাজনৈতিক
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলন শেষ করে দুজনেই
পাড়ি দিয়েছিলেন সিংভূমের চাইবাসায়।স্বাধীনতার বাণী প্রচারের জন্য তাঁদের
যৌথ প্রয়াসে সাপ্তাহিক তরুণ শক্তি পত্রিকার জন্ম হয়েছিল সেই সব ইতিবৃত্ত বলে যাচ্ছিলেন
অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী।কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম তাঁরা পায়ে
হেঁটে গেছেন সংগঠিত করেছেন মানুষকে।এই সময়েই প্রকাশিত হয় তরুণশক্তি।
এই পত্রিকা যুব সমাজকে আলোড়িত করেছিল প্রবলভাবে।
তরুণশক্তি করতে গিয়েই রাজরোষে পড়ে আবার জেল হয় দুজনের।
চার বছর কারাবাসের
পর ১৯৩২ সালে মুক্তি পেলে অন্নদাপ্রসাদ ফিরে
আসেন রামচন্দ্রপুরে, তাঁর বন্ধু কলকাতায় ফিরে যায়।
সেখানে তৈরি
করেন সংকল্প পত্রিকা।সংকল্প বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।
কিন্তু কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের পরই তা বন্ধ করে দিতে হয়।
ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে পুঞ্জিভুত ক্ষোভ আর বিদ্রোহের
সুর স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার প্রতি পাতায়।
সংকল্প পত্রিকার পরে নাম বদল হয়।
তারাশঙ্কর শৈলজানন্দ প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক
সাহিত্যিকই লিখেছেন সকল্পের পাতায়। ডঃ শ্রীকুমার
বন্দ্যোপাধ্যায় , ডঃ সুনীতি চট্টোপাধ্যায় , ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রথী মহারথীরা মিলিত হতেন সংহতির আড্ডায় ।
বিপ্লবী সাহিত্যপ্রেমী মানুষটি
তাকালেন বাবার দিকে-
তুমি মোহিনী না ?
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো হল। “ আমাকে তো চেনার কথা নয় তাঁর , কখনও কোথাও দেখেছেন
বলে মনেও পড়ছে না । তাহলে প্রকৃত
কবিদের কি দিব্যদৃষ্টি থাকে যা দিয়ে তাঁরা অন্তরের সবকিছু দেখতে পান ।“ ভাবনা শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় প্রশ্ন -রাখুদা
, কেমন আছে এখন ?
আপনি বাবাকে চেনেন ? জিজ্ঞাসা নয় একবুক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে বাবা।
-
রাখুদার সাথে কি আজকের পরিচয় , সেই কবে কতদিন থেকে তাঁর সাথে সংযোগ আমার ।
শ্রদ্ধাপূর্ণ এক পরম আনন্দে বাবা প্রণাম করতে গেলে
তিনি জড়িয়ে ধরলেন বুকে – ব্যক্তিকে নয় প্রণাম করতে হয় তাঁর কাজকে।
যদি কোনদিন
আমার কাজগুলো তোর ভালো লাগে সেদিনই হবে আমাকে আসল শ্রদ্ধা
জানানো।
তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একখানি পত্রিকা বের করে
দিলেন বাবার হাতে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে সংহতি পত্রিকার
নাম। সংকল্প পত্রিকার পরিবর্তিত নাম।
কাগজের নীচে
ছোট করে লেখা – সম্পাদক সুরেন নিয়োগী ।
-
আপনিই সুরেনবাবু ।
জিজ্ঞাসা না কি বিস্ময় ।
স্থির হয়ে আছে
বাবার চোখ ।
-
সুরেনবাবু নয়, সুরেন কাকা।
বুকের মধ্যে
জড়িয়ে ধরলেন তিনি। রাখুদাকে আমার কথা বলিস।
দেখা হয়েছিল তাও বলিস।
আজ সংহতি
পত্রিকা বা সুরেন নিয়োগীর নাম বিস্মৃতপ্রায়।
দীর্ঘ সময় ধরে এই পত্রিকাটি প্রয়াশিত হয়েছিল ।রবীন্দ্রনাথ থেকে আরম্ভ করে প্রায়
প্রত্যেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকই লিখেছেন সংহতির পাতায়।
এরকম সাহিত্য সংগঠক আজও বিরল।
বাবার সাথে সুরেন নিয়োগীর প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তটি ছিল এরকম। পরে সংহতি
পত্রিকার সাথে এক নিবিড়
সম্পর্ক গড়ে ওঠে বাবার। পরে অনেক পরে বাবা
একদিন তাকে একান্ত আলাপচারিতায় জিজ্ঞেস করেছিলেন –আপনি আমাকে চমকে দিয়েছিলেন সেই প্রথমদিন।
কী করে চিনেছিলেন?
‘বলিস কি রে, তোকে চিনব না। তোকেই তো
খুঁজছিলাম।’ গলার স্বর খানিকটা মৃদু করে বলেছিলেন -সব খবরই তো আমাদের রাখতে হয়।
রাখুদার সাথে পরিচয় তো ছিলই। সাইকেল চালিয়ে সাতুড়ি থেকে কতবার রামচন্দ্রপুরে এসেছে। দেখা হয়েছে। মোহিনীকে চিনেছি তার শব্দে।
শব্দের ভেতরই থাকে একজন কবির অবয়ব। সবাই সেই চেহারাটা দেখতে পায় না, আমি পেয়েছি।
No comments:
Post a Comment