ওবায়েদ আকাশ-এর নতুন ও
পুরনো কবিতা
দুটি
নতুন কবিতা
....................
রক্তের
ধারা
মাছবাজারে যে মাছটির দরদাম নিয়ে
কথা কাটাকাটি হাতাহাতির দিকে যাচ্ছিল--
তার পাশের ডালা থেকে একটি কর্তিত কাতলের মাথা
আমার ব্যাগের ভেতর লাফিয়ে ঢুকে গেল
তখন মস্তকবিহীন কাতলের অবশিষ্ট দেহের দিকে তাকাতেই
আমার সমস্ত শরীর রক্তে লাল হয়ে গেল
কাতলের যিনি প্রকৃত ক্রেতা ছিলেন
মানিব্যাগ থেকে মূল্য পরিশোধ করে বললেন--
“এ নিয়ে
কিছু ভাববেন না হে
আজকাল মাছেরা যেভাবে রক্তপাত করতে শুরু করেছে
এভাবে চললে আপনি-আমি সবাই এমন রক্তে নেয়ে যাবো”
আর তৎক্ষণাৎ বাজারের সকল মৎস্যবিক্রেতা যার যার রক্তের ধারা
আবিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে গেল
কেউ বলল: আমি সেন বংশজাত, আমি পাল বংশোদ্ভূত, আমি...
এবং দেখা গেল, বাজারে যে ক’জন ক্রেতা ছিলেন
শুধু তারাই ছিলেন মীনবংশজাত
যারা নিজেরাই নিজেদের মাংস ভক্ষণ করতে
বাজারে এসে কথা কাটাকাটি থেকে রক্তারক্তি পর্যন্ত চলে যেতে পারে
তোমার
সম্রজ্ঞীর জীবন
একদিন দূরের সমুদ্র ধরে ডুবতে ডুবতে
তোমার অন্যায্য নিকটে এসে
সারা দেহে পাখির পালক মুড়িয়ে বলব যে
তোমার সম্রজ্ঞীর জীবন কেন
বিষাদে ভরপুর ছিল
আর তুমি বিন্যস্ত নকল পালক ধরে
উড়ে যাবার বাসনা করতেই আমি
মাছ হয়ে সমুদ্রে মিলিয়ে যেতে পারি
তখন যতই বাসনা হোক-- লালনীল
মাছেদের ডানায় তোমার ভবিষ্যৎ সন্তরণরীতি
কিছুতে ভাবতে পারি না আজকাল
এবং তোমার জন্য উদ্যত এই সমুদ্রশূন্যতা
আমাকে বারবার প্রাচীন লোকালয় ঘিরে
হেঁটে যেতে উদ্বুদ্ধ করে--
আমি মনুষ্য অবয়বহীন সিন্ধু বা পবনপ্রেমিক
তোমার সম্রাজ্ঞী-জীবনের
অভিশাপের ক্ষুধায়
না মানুষ না জলজ জীবনে স্থিত হতে পেরেছি
কয়েকটি
পুরনো কবিতা
...........................
প্রকৃতিপুত্র
ভাবতে গেলে তুমিই একদিন
আমাদের হারানো শেকড়, হারানো চুল, বয়সভেদে
ছোট হয়ে আসা পরিত্যক্ত পোশাকের ধরন, ছায়াভিত্তিক
ঘাসের আকৃতি, বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা মাঠ--
আলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে ধানক্ষেতে পড়ে যাবার স্মৃতি--
একদিন ডেওয়া ফলের ঘ্রাণের মতো ফিরিয়ে দিতে পারো
যখন সাঁকোর কম্পন দেখে বুঝে নিতাম
মাছেদের হৃৎপি-ের ধ্বনি, স্রোতের প্রবাহ দেখে মনে হতো
ভেসে যাচ্ছে সম্রাট দারায়ুস কিংবা স্কাইলাক্সের অধিকৃত রাজত্বের
ধ্বংসাবশেষ
আর যত্রতত্র অশ্বদৌড় দেখে মনে পড়ত
সেই সকল ক্রীতদাস ব্যবস্থার প্রবর্তক, যাদের
ঐসব দুরন্ত অশ্বের লেজে জুড়ে দিয়ে
ঘোরানো হচ্ছে কাঁটাঝোপ, বনবাদাড়, তপ্ত মরুভূমি--
একদিন আলোছায়ার নক্ষত্রের মতো
তুমিই তার ভালমন্দ, উঁচুনিচু শিখিয়ে নিতে পারো
যখন মাথার ওপর সুস্নিগ্ধ মেঘের পরিচ্ছদ দেখে
মনে হতো প্রাগৈতিহাসিক কুশলীরাজ কিংবা প্রাচীন গ্রীসীয়
স্থাপত্যপ্রেমিক কোনো রাজরাজড়ার মহান কীর্তির কথা--
কিংবা মনে পড়ে যেত-- গাছে
গাছে বিবিধ কূজন আর বর্ণালি ফলের
আস্ফালন দেখে ইবনে বতুতার চোখে অপ্সরী ও গন্ধর্বের পরম সংসার; আর
অতল সুখের এই পলিধৌত সুশীল রাজ্যের মতো স্বর্গীয় মাতৃভূমির কথা
ভাবতে গেলে একদিন তুমিই তার আগাপাছতলা দেখে ফেলেছিলে
আজ আবার পুনরুদ্ধারিত গৌরবের মতো
তারই কিছু গ্রহণ বর্জন সুখ স্মৃতি অনায়াসে তুলে ধরতে পারো জানি
কাগজ
থেকে বেরিয়ে
চলো কাগজ থেকে বেরিয়ে পড়ি
স্টেশনে যাই, ট্রেনের ছাদে উঠে ফুটবল খেলি
প্রতিদিন কাগজে থেকে, ব্যাপক পৃথিবীটা
কেমন অচেনা হয়ে উঠছে
সমুদ্রটা অজানাই থেকে গেল
অথচ বেরিয়ে পড়লে কত কিছু করা যায়
রুটির মতো উল্টেপাল্টে দেখা যায় চাঁদ
তারাগুলো কর্জ করে মার্বেল খেলা যায়
চলো কাগজের এই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র পাতা ছেড়ে
বরং সমুদ্রে চড়ে বসি, তার অতলে ডুবে যাই
বিস্তৃত প্রাণিজগতের বাসিন্দা মনে হবে তাতে
তাছাড়া কাগুজে সংসারে থেকে প্রতিদিন পলায়নের চেয়ে
ডুবুরির মতো সমুদ্রতলে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানো যাবে
ভাবতে ভাবতে পাড়াগাঁয়ের সমস্ত মাঠ এসে
চড়ে বসল আমার কাগজের পাতায়--
গরু চড়াল, মলন ছড়াল
রাত ভরে শুরু হলো বীর গাজির গান
আর ভোরবেলা যখন লাঙল চড়াতে যাবে
তখন তার পিছু পিছু এই কাগজ থেকে বেরিয়ে পড়ব ঠিক
ইতোমধ্যে এই ব্যবহৃত কাগজের প্রতি মায়া
আর একবার সমুদ্র আর একবার শৈশবের
মাঠের জন্য মায়া-- আজকাল
কে যেন আমাকে
দ্বিধান্বিত পৃথিবীর দিকে ইশারা করে যায়--
হাসপাতাল
থেকে ফিরে
আমি যখন পাগল হয়ে ফিরে এলাম
দেখি, কেউ আমার চেনা নয় আর
স্ত্রীকে বলি-- ভাবি, তোমার মতো মেয়ে, যারা
সারারাত্রি স্বাস্থ্যসেবা করে
তারা কেউ নয় আমার স্ত্রীর মতো পরিচর্যারত
আমি তাদের চুমু খেয়ে, গন্ধ শুঁকে
মুখ ভরে ঢেলে দিই বাংলা মদের ঝাঁঝ
তারা বলেÑ তাদের
ঘরে রাত্রিযাপন
নির্বিঘ্ন
হরিণ শিকারই
ভাবি বলে বাপু-- ‘তোমার সন্তানগুলো
তারা তো ঘুমিয়ে পড়েছে
আমাকে খুঁজতে এসেছে মধ্যরাতের মাঝি’
আমি দারোয়ান সমেত কাউকে বেরিয়ে যেতে দেখি
দেখি, ডাক্তার এসে আমার পালস দেখছে, গাল টিপছে
আমার হাড় কব্জি ঘষে-ছেনে তার দীর্ঘ কালো চুলে
ঢেকে দিচ্ছে মুখ
আমার নিঃশ্বাস বাড়ছে, আর
সে তার কম্পিত ঠোঁটে রাক্ষস হয়ে চেটে খাচ্ছে রোগ
অভিনেতা
তীর্থঙ্কর
তীর্থঙ্কর মজুমদার আমাদের বাড়ির ছেলে
তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেহারাটা দর্জিখানায় সেলাই হচ্ছে
চিবুকের প্রশ্রয় থেকে একগুচ্ছ চুল নাভির ওপর দোল খাচ্ছে
সকাল থেকে একটি কাঠকয়লার বাস এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে আঙিনায়
তাতে বসন্তকাল, কোকিলের ডাক
সারাদিন চড়ে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত
তীর্থঙ্কর, অভিনয়ের প্রাক-ভূমিকায়
তার গোফের ওপর বসিয়ে দিল নার্সারি। তাতে
যা লাভ হলো :
ফুটে থাকা দুচারটি ফুলে আবশ্যক পারফিউমের কাজটি অন্তত হয়ে গেল
আর এখন তাতে ফল ধরবে-- যা পেড়ে
খেতে
তীর্থঙ্করের সস্নেহ আশীর্বাদ প্রয়োজন পড়বে তোমাদের
একটি
সাম্প্রতিক কবিতার খসড়া
গত শরতের দিকে
যথার্থই ভাল লোক বলে তোমাদের নিমন্ত্রণ পেলাম
হাঁড়ি-কলসির নিশ্ছিদ্র সাজানো ফটকে
তোমাদের অভ্যর্থনা পায়ে পড়ে গেল
বলা হলো--
জাহাজ ছুটছে
ঢোল বাজছে
রুটিতেই আপনার প্রচণ্ড আসক্তি, তাই তো?
বললাম, ‘না’
তাহলে ভেতরে ঢুকুন
জানেন তো, কেরোসিনের ফলন ভাল
এ নিয়েই দুটো কথা বলা হোক
দেখছ যে, সিঁদুর রাঙানো ষাঁড়
ও থেকে আমরা রোজ কেরোসিন দুহাই
কেরোসিন খাই...
ট্রেন এসে যাচ্ছে, আমার শ্যাম্পুর পাতা?
এ সবই মায়ের জন্য উপহার
মা বলেন, ‘খ্যাতি নেই খাদ্য নেই
পারফিউমের গন্ধে আমার
উঁট্কি আসে বাবা’
যা দিনকাল, আপনারা সরুন তো
সুঘ্রাণ আসছে
সুঘ্রাণের
জন্মদিন ছিল
আমার নেমন্তন্ন
ছিল
সংবর্ধনা
পায়ে পড়েছিল...
খাতায় মার্জিন টানুন... আমাদের ছবির মাপ নিন
আমার মায়ের নাম :
কেওড়াজল
বাবা
: গন্ধবণিক
পেশা
: দিগ্বিজয়
--এভাবে ক্যাপশন দিন
...চলুন
কাস্টমসের দিকে
সঙ্গে হোমিওপ্যাথ
বাবা ডাক্তার ছিলেন
ভাল মেয়ে দেখতে পারেন
স্যার, আমার ফাইলপত্রে
এক ডজন সুন্দরী বেড়াতে এসেছেন
গায়ে ডেটলের ঘ্রাণ, লাইকলি ইমিগ্রান্ট
ভাগ্যটা খুলে নিন স্যার
দ্রুত ফিরে চলুন, বাংলার টিচার
রোল-কল হবে
নো লেট-মার্ক
--টিচার, আপনার ছাত্রীদের ডাকে ধর্মঘট
কাল আসবো না
বাসায় বেড়াতে যাবো, থাকবেন টিচার?
সঙ্গে সংবর্ধনা
সুঘ্রাণ
বাবা-মা থাকবেন
আফিমের ঘ্রাণ পাচ্ছ?
দোতলার ছাদে আফিমের চাষ হয় খুব
ডবলডেকারে ওঠে
স্কুলে যায়
ভাল শিস্ দেয় মিনি স্কাট
ছাদে রোদ এলে পত্ পত্ ওড়ে পাজামার ফিতে
আর মনে পড়ে পঙ্কজ উদাস
হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া
জলতরঙ্গ...
বিটোফেন...
মোৎসার্ট...
‘বেলা
বোস তুমি শুনতে পাচ্ছ কি?’
ডব্লিউ ডব্লিউ ডট অঞ্জন দত্ত ডট...
আহা প্রতুল-দা আলু ছোলা বেচে উজাড় করেছেন
কফি হাউসের রোদে
ফোলা ফোলা গাল বসে থাকে
মরুভূমির নাভি
ধারী
ধারী পাছা
কাল আপনাকে দেবদাস ছবিতে দেখেছি
সংবর্ধনাকে ভাল চিনবার কথা আপনার
‘ইয়েস অনলি শি
ইজ!’
চলুন মা’র কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসি
এত হাসি হাসি কথা কী করে বলেন?
আপনার বোগলের ঘ্রাণে বমি বমি লাগে
--কোলে তুলে নিন, ওজনে পাতলা
ভাল স্বাস্থ্য
একহারা
পছন্দ : এ্যাশ টি শার্ট
ব্ল্যাক
জিন্স
হানড্রেড
পাইপারস
প্রিন্স ইগোর
এ্যাবস্যুলুট
হোয়াইট মিশ্চেল
জ্যাক ড্যানিয়েল...
আর
টোল পড়া গাল
একটি রং নাম্বার ডায়াল, হাসপাতাল!
রিয়েলি লোনলি ডাক্তার
পেইন কিলার, প্লিজ...
--সিস্টার [নার্স] আপনার ফ্রকের হুঁকগুলো
খুলে যাচ্ছে কেন?
--ম্যাডাম [ডাক্তার] আপনার এ্যাপ্রোনটি
ভীষণ উড়ছে বাতাসে
আমার চশমাটা খুলুন
মাইনাস থ্রী পয়েন্ট ফাইভ [-৩.৫]
পূর্বপুরুষের ছিল
চশমাটা ভেঙে দিন, আপনার শুশ্রূষা
বড় প্রয়োজন
আরও শীঘ্র ভাল করে দিন
মা বকবেন
তিনি তো অফিস যান না কতদিন
সকাল সকাল শেভ হয়ে যাচ্ছে
ধোঁয়া উঠছে চায়ে
(মধ্য
দুপুর... জলপাই-রং জীপ... হ্যান্ডকাপ...)
অভিযোগ : ক. রঙধনু
দেখা
খ. দেদার গঙ্গার প্রবাহ অঙ্কন
গ.
শীতবস্ত্রহীন
ঘ.
বুকপকেটে প্রেমিকার চুম্বনের ছাপ
ঙ.
প্রেসক্রিপশন
চ.
শালপাতার বিড়ি
আমাকে গেট অব্দি পৌঁছে দিন
যাবজ্জীবন, সশ্রম...
প্রিয় শোক : ১. জীবনানন্দ
দাশ
২. সমুদ্র ভ্রমণের
দিনগুলি
বালাগাল উলাবে কামালিহি...
আপনাকে খুব সুফি সুফি লাগে
আপনি হারামির মতো মুখ ভার করে হাসেন
আপনি খুব পর্নো পড়েন
কিছুটা ঘুমিয়ে নিন
আপনার কিছু ঘুমের প্রয়োজন আছে
ঘুমের মধ্যে আপনি খুব মন খারাপ করেন
কেউ ফুটপাত ধরে হাঁটছে
যাবজ্জীবন ঘুমের কথা আপনার মনে পড়ছে না তো!
বৃষ্টি
এবং মেঘলাগাছ
তোমার সাথে দেখা হলে একলা একটি
গাছের ভেতর মর্মরিত দুঃখভেদে পরস্পর বৃক্ষ হয়ে যাই। আর যাই
বলো, মাছের
কানকোয় চড়ে দুঃখদের জলভ্রমণের দিনে তোমার কাছে যাবো না বলে ভাবতেই পারি না। তোমাকে
একজন বৃষ্টির কথা বলি : একজন শরৎকালের নাম রাখা আছে বৃষ্টি। প্রজন্মান্তরের
এই ধারণার ওপর আমাদের কোনোই হাত ছিল না। আমাদের এই শিশু-বিদ্যায়তন
ফি বছর শরৎ এলেই খুলে দেয়া হয়। আর শরতের বৃষ্টিতে
কাশফুলের ভিজে ওঠা দেখে পাড়ার শিশুরা সকল একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার নাম দেয় বৃষ্টি। এবারেও
আমাদের কোনোই হাত থাকে না। আর এই শিশু-সন্তানেরা
মা মা করে ডেকে উঠলেই,
সকলের প্রিয় বৃষ্টি হতে বৃষ্টি ঝরে পড়ে। ওরা বলে : এই
পৃথিবীর দৈত্য-দানোর গল্প বলো মা! তখন আমি আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ি, মেঘলাগাছ। শিশুরা
সব নানান পাতায় ঝুলে গেলে,
মা-র মনে পড়ে তেঁতুলগাছে ঝুলে থাকা বাদুড়ের ঝাঁক। প্রিয়
শিশুদের শিশ্নের ডগায় চুমু খায় আর বলে : এবার আমি আর মেঘলাগাছ তোমাদের জন্য একটি স্বশিক্ষিত
বিদ্যায়তন নিয়ে ভাবতে বসে যাবো। শরৎ ফুরিয়ে এলো; বৃষ্টিকে তারা
নির্জনে গেঁথে প্রত্যেকে ঘরে ফিরে যায়
ধীরেন্দ্র
আর ভুশার নস্টালজিয়া
‘ধিরে, সুখ নাই।’
[ভুশার একমাত্র ঘোড়াটি গতরাতে চুরি হয়ে
গেছে। কিংবা ধারণা করা যায়, এ মুষল বৃষ্টিতে
ঘোড়াটির দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়।]
‘কেন?’ Ñবলল ধীরেন্দ্র।
আবার ধীরেন্দ্র কয়, ‘তোর থেকে ত্রি-দন্ত
চতুর কেউ একজন ঘোড়াটির আজকাল খোঁজখবর নেয়।’
‘ধিরে, এখন কী করি?’
‘যত দূর জানা আছে, তার কিছু তথ্য
বের করি।’
[তথ্যে বেরিয়ে পড়ে, এ ভরা শ্রাবণে, তিনিও ঘোড়ায়
চেপে হঠাৎই ছুটছেন নাকি সোমত্ত কৈশোরের দিনে।]
‘মাঝি, কোন ঘাটে ভিড়বে তোমার তরী?’
[নদীতীরে ধীরেন্দ্র আর ভুশা, তাদেরও শৈশবের
দু’টি টিকিট
যদি মেলে!]
মাঝি বলে, ‘আপনারা ব্যাটা
নাকি ছেলে?’
এ ওর দিকে চায়, তারপর ধীরেন্দ্র
বলেÑ ‘মুশকিলে পড়িলে
ভুশা, মাঝিও
মনের কথা রঙ ধরিয়ে বলে।’
রূপনগর
রূপনগর আমার হাত থেকে একদিন কেড়ে
নিয়ে গেছে চালতার ব্যাগ। আমার প্রিয় চালতাফুল, যাকে বড় হতে
দিয়ে একদিন ছ’টাকায়
উঠে পড়ি এই নগরের ট্রেনে;
সঙ্গে ইলিশ পোড়ার ঘ্রাণ, কাগজী লেবু, অথৈ দীর্ঘশ্বাস... এই ফাঁকে মাটির হাঁড়িতে
জল, শিং
মাছের ঝোল-- এই নিয়ে ট্রেনের কামরায় কামরায় কেউ গান
ধরে দিলে ঝিলপাড় থেকে ডগাভাঙা দুবলার কষে কেউ কেউ ধুয়ে নেয় হৃদয়ের ক্ষত। আর তাতে
বনমরিচ, বুনো
বিছুটির মতো টগবগ করে ছুটে যায় ট্রেন উত্তরের দিকে। আর আমি
দুধভরা গাভীর ওলান ভেবে দুই হাতে খুঁজে পাই পুরু ফ্রেমের তলে ফোলা ফোলা চোখের অসুখ। বাঁশবাগান, ঘাসফুল, প্রাচীন হালটের
ঢালে বাতাবিলেবুর ফুলে এমন আষাঢ়ের দিনে, একদিন মৌমাছি তুলেছিল বৃষ্টির ভাষা; অথৈ সবুজ থেকে
নুয়ে পড়া স্নেহের গভীরে বসে চালতাফুল, ক্রমে তারা ফিরে পায় বহুরঙ মানুষের রূপ।...
রূপনগর, এই প্রিয়
অভিবাস মুখরতা কোলাহলে ছায়াহীন ভালবেসে বসে আছে অজস্র স্টেশন শেষে
বাংলাদেশে একদিন ইংলিশ রোড নামকরণ
হলো
আমার নাম দাও শিবপোকা। শিবপোকা
মানে, একটি
নতুন পোকার নামকরণের ক্ষমতা।... তুমি করো দোয়েলের
চাষ। দোয়েল কি পরিযায়ী নাম? ইংলিশ রোডের
কোলাব্যাঙগুলো সেবার বর্ষায় ছিল সাদারঙ হয়ে। আমি জানি, এ প্রকার জলসাদা
ব্যাঙ পৃথিবীতে কখনো ছিল না। এমন ব্যাঙরঙ
ধরে যখন ভোর হয়, আবার
কৈবর্তপাড়ায় ভেঙে যায় রাজ্যের নিয়ম। কেমন আফিমগন্ধে
বাজারের আঁশটের ভেতর আমি শিব শিব করে পোকা হয়ে উড়ি তোমার তালাশে।...
তুমি করো দোয়েলের চাষ।... ভাল ছাইরঙ বোঝো।...
মেটে কলসি, লাউয়ের
খোঁড়লে কী গভীর সুর তুলে আনো। তোমাকে জানাই
তাহলে, আমাদের
ইংলিশ রোডের কোলাব্যাঙগুলো আমার জিহ্বার তল থেকে একদিন তুলে নিয়ে গেছে সমস্ত লালা। সেই
থেকে সুরহারা হয়ে শীতল শস্যের মতো তোমাকে সযত্নে রাখি
ঘরের নিভৃত কোণে। তুমি তো জানো, কতোটা বেসুরো
হলে হাটের গুঞ্জন ওড়ে আকাশে বাতাসে
শিশুপুত্রের
অভিলাষ
টেবিল থেকে লাফিয়ে নামছে কবিতার খাতা
আমার শিশুপুত্র কবি হতে চেয়ে বায়না ধরেছে এবছর
খাতাটি লাফিয়ে নামছে মাটিতে আর
ছেলেটি তার নিচ দিয়ে অনায়াসে ঢুকতে পেরে
এক অসামান্য খেলায় মেতে উঠেছে
পড়ে যাওয়া খাতার শরীরে হাত দিয়ে দেখি
তপ্ত জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা
ছেলেটি মা মা করে কাঁদছে
আর বাবার সংগ্রহ থেকে
একটি একটি ঘুমের পিল বিরামহীন খাইয়ে চলেছেন মা
এবং ভোর হতে না হতেই স্নানঘরে ঢুকে
প্রতিটি কবিতার গায়ে অঝর ধারায় জল ঢেলে দিচ্ছে
পঙ্ক্তিগুলো আরো জল আরো জল বলে
শরীর থেকে সমস্ত বসন খুলে
নিজেদের গা ছেড়ে দিল অমৃত ধারায়
এই এক শিশুপুত্র প্রতিদিন একটি-দুটি শব্দ
সারারাত জলে ভিজিয়ে রেখে ভোরবেলা
বাবার হাতে তুলে দিয়ে ভীষণ তৃপ্ত হচ্ছে আজকাল
আমার ঘরভর্তি জ্বরতপ্ত খাতা আর শিশুপুত্রের
ভেজা কোমল শব্দগুলোর ভেতর একপ্রকার
যোগসূত্র নির্ণয় করতে চেয়েছি
বিপরীতে আজকাল তারা আমার নিঝুম উঠোনের
শরীরের উত্তাপ নিয়ে গবেষণাগার ভারি করে তুলছেÑ
মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প
বারান্দায় সিঁদ কেটে চুরি হয়ে গেছে আমার প্রিয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
শ্রেষ্ঠ গল্পের বইটি। তাতে আমার কোনো হাত নেই। কেননা, এ বইয়ের একটি
গল্পও যখন পড়া ছিল না,
তখন একদিন হারানের নাতজামাই ছোটবকুলপুরের যাত্রীদের কাছে নিয়ে এসেছিল কতগুলো উলঙ্গ
টিকটিকির ছানা। আমি তাদের ছোটোখাটো লেজগুলো ঝরে পড়তে
দেখি; দেখি
তাদের বিপন্ন নাচানাচি;
যারা হাসছে, কাঁদছে
আবার এই মতো বিচ্ছিন্নতায় ক্ষুধার জন্য মিছিলে যাচ্ছে, বিপ্ল¬ব করছে... আর
সুরক্ষিত এলাকা থেকে তাদের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে নিয়মিত ঠ্যাঙারে বাহিনী; আমাদের প্রিয়
মানিক দা তার কোনো প্রাক-গল্পের ভূমিকায় এ সংক্রান্তে কতদূর কী লিখেছেন, ভেবেছেন--
সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না কোনো
*************************************************************************
‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’ গ্রন্থের কবি পরিচিতি
ওবায়েদ আকাশের কাব্যভাষার নতুনত্ব ও ভিন্নতা এখন সর্বস্বীকৃত। গড্ডল
স্রোত থেকে নিজেকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন লিটল
ম্যাগাজিন। এবং শালুক নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনও
সম্পাদনা করছেন ১৯ বছর ধরে। ওবায়েদ আকাশ
কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বি মনে করেন না, তিনি নিজেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি। নিজের
কবিতা দিয়ে নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়াতেই তাঁর আনন্দ। তাঁর
কবিতা সর্বভুক হলেও-- বাংলাদেশের শ্যামলহরিৎ প্রকৃতি ও নিসর্গবর্ণনা
অনিবার্য অনুষঙ্গ। তারপর বিশ্ব ও পরাবিশ্ব। গত শতকের
নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত হয়ে তিনি তাঁর সময়কে চমকে দেন। নির্মাণ
করেন এক ঈর্ষণীয় কাব্যভাষা-- যা তাঁকে আজ
নতুনতর কবিদের আইডলে পরিণত করেছে। ‘তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর’ গ্রন্থে তিনি
নিজেকেই অতিক্রম করেছেন,
স্বনির্মিত কাব্যভাষায় সংযোজন করেছেন আরেক দিগন্তভূমি।
ওবায়েদ আকাশের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন; রাজবাড়ী জেলার
সুলতানপুর গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর তিনি। পেশা
: গণমাধ্যমে চাকরি। বর্তমান কর্মস্থল : দৈনিক সংবাদ।
প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা : কবিতা, অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদনা মিলিয়ে
৩৪টি। জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি প্রকাশ
করেছে তাঁর বাছাই কাব্য সংকলন ‘উদ্ধারকৃত মুখমণ্ডল’ (২০১৩)। কলকাতা
থেকে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ। দেশ বিদেশ থেকে
পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন একাধিক। উল্লেখযোগ্য
: এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি পুরস্কার ২০০৮। কলকাতা
লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯। লন্ডন
থেকে প্রাপ্ত সংহতি লিটারারি সোসাইটি বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১২ এবং ঐহিক সম্মাননা ২০১৬।
email :
oakash1971@gmail.com
ওবায়েদ
আকাশের গ্রন্থাবলি
উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ:
পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১)
নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩)
দুরারোগ্য বাড়ি (২০০৪)
কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫)
পাতাল নির্মাণের প্রণালী (২০০৬)
তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭)
শীতের প্রকার (২০০৮)
যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০)
প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (২০১১)
রঙ করা দুঃখের তাঁবু (২০১২)
বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০১৩)
তৃতীয় লিঙ্গ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ২০১৩)
উদ্ধারকৃত মুখম-ল (বাংলা একাডেমি কর্র্তৃক প্রকাশিত নির্বাচিত
কাব্য সংকলন, ২০১৩)
হাসপাতাল থেকে ফিরে (২০১৪, কলকাতা)
৯৯ নতুন কবিতা (২০১৪)
পাতাগুলি আলো (২০১৬)
মৌলিক পৃষ্ঠায় হেঁয়ালি (২০১৭, কলকাতা)
তথ্যসূত্র পেরুলেই সরোবর (২০১৮)
বাছাই কবিতা (২০১৮)
শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ:
ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ (২০১৮)
অনুবাদ:
‘ফরাসি
কবিতার একাল/কথারা কোনোই প্রতিশ্র“তি
বহন করে না’ (২০০৯)
‘জাপানি
প্রেমের কবিতা/এমন কাউকে ভালবাস যে
তোমাকে বাসেনা!’ (২০১৪)
গদ্যগ্রন্থ:
‘ঘাসের
রেস্তরাঁ’ (২০০৮)
‘লতাপাতার
শৃঙ্খলা’ (২০১২)
সম্পাদনা গ্রন্থ:
‘দুই
বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (২০১২)।
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন:
শালুক (১৯৯৯-)
একজন কবিকে একটু বেশী জানা এবং পড়ার নান্দনীক সুন্দর এই আয়োজন ভালো লাগলো। ভালো লাগলো ভালোলাগার কবিকে পড়ার সুযোগ করে দেয়ায়। ধন্যবাদ সংশ্লিষ্টদের।
ReplyDeleteবাঁকের এই আয়জনকে স্বাগত জানাই।
ReplyDeleteকবি ওবায়েদ আকাশের এতোগুলো কবিতা এবং তার কাজ নিয়ে সুন্দর আয়োজনের জন্য। কবির জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা।