"পথেই এবার নামো সাথী পথেই হবে এ পথ চেনা
প্রদোষ পাল
‘বাক্’ পত্রিকায় 'বিষয় চলচ্চিত্র' বিভাগে পৃথিবীর অনেকগুলো বিখ্যাত চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করলুম। সামান্য একজন আঁকিয়ের চোখ দিয়ে সিনেমাকে যেভাবে দেখছি, সেভাবেই আলোচনা। কারো ভালো লেগেছে, কারো ভালো লাগেনি। তবে বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রায় বারো-চোদ্দটি ছবির আলোচনা অনেকের মধ্যে অন্যধারার সিনেমা সম্পর্কে যে আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করেছে এটা আমি অনেক ভাবে বুঝতে পেরেছি। এখন অনেকেই বিশ্ব চলচ্চিত্রের ভালো ছবি সম্পর্কে খোঁজ খবর করছেন। এটা কম পাওয়া নয়। পাশাপাশি এমনও অনেকে ভেবেছেন, ভারতীয় কোনো সিনেমা কি পাতে দেওয়ার মতো নয়? তেমন কোনো ছবি নিয়ে আলোচনা কেন উঠে আসেনি আমার আলোচনায়? আসলে ভারতীয় চলচ্চিত্র অনেক সহজলভ্য। সন্ধান পাওয়া খুব একটা কঠিন নয়। অনেকেই ভারতীয় চলচ্চিত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই ওদিকে বিশেষ একটা পা বাড়াইনি। 'বিষয় চলচ্চিত্র' বিভাগে শেষ লেখায় এবার একটি বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা করলাম। আমার মতে এ ছবি ছাড়া ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্র আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
'উদয়ের পথে' সিনেমাটির নাম শুনেছিলুম, কিন্তু দ্যাখার সুযোগ হয়নি। প্রসঙ্গটা বলছি বছর আট বা দশেক আগের। মানে তখনও সোশ্যাল মাধ্যমের দাপট বাড়েনি। ইউটিউবের রমরমা ছিল না। দ্যাখার সুযোগ বলতে বিশেষ কোনো চলচ্চিত্র উৎসব বা দূরদর্রশনের কল্যানে। তাও সব সময় যে চোখে পড়বে বা খোঁজ পাওয়া যাবে তার কোনো মানে নেই। সেই দূরদর্শনের বাংলা চ্যানেল, ডি ডি বাংলায় হঠাৎ একদিন চোখে পড়লো। কাহিনির বেশ কিছুটা গড়িয়ে গিয়েছে তখন। মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে দেখলুম বাকি অংশ টুকু। পুরোটা যে দেখতেই হবে! যে করেই হোক দেখতেই হবে! কিন্তু কি করে সম্ভব? খোঁজ নিয়ে দেখলুম বাজারে তখনও সিডি বা ডিভিডি প্রকাশ পায়নি। দেড় দু বছর অপেক্ষার পর সিডি পেলুম।
১৯৪৪ সালে পরিচালক বিমল রায় বানিয়েছিলেন 'উদয়ের পথে'। অর্থাৎ 'পথের পাঁচালি'র ১১ বছর আগে (১৯৫৫)। ‘পথের পাঁচালি’-র কথা বলার কারণ ভারতীয় চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃত বলা হয় এ ছবিকে। সঙ্গত কারণও রয়েছে যথেষ্ট। দেশ বিদেশের পুরষ্কার ও জনপ্রিয়তায় 'পথের পাঁচালি' অনন্য জায়গা করে রেখেছে। কিন্তু তার ১১ বছর আগে 'উদয়ের পথে' ছবি কজন দেখেছি বা কজন এমন একটা ছবির কথা জানি বা বলি?
জানিনা চলচ্চিত্র বোদ্ধারা এ ছবিকে কোন পর্যায়ে রাখবেন! মানে 'কমার্শিয়াল' না 'আর্ট ফিল্ম'! কমার্শিয়াল বলাই স্বাভাবিক। নায়ক নায়িকা রয়েছে। নাচ নেই, কিন্তু গান তো রয়েছে। সুতরাং 'আর্ট ফিল্ম' বলা যাবে না। আমিও বলছিনা। কিন্তু বিশেষ মর্যাদা দিতেই হবে 'উদয়ের পথে'কে। টান টান চিত্রনাট্য অবিশ্বাস্য মনে হয়। ‘উদয়ের পথে’ ছবির আরো ৭ বছর আগে (১৯৩৭) নির্মিত হয়েছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার 'মুক্তি' ছবি। ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস আলোচনা করতে 'মুক্তি'-র কথা আনতেই হবে। বিশেষ করে দু:সাহসিকতায়! চিত্র শিল্পীদের পর্দায় যেভাবে ন্যাকা ন্যাকা দ্যাখানো হয়, তার বিপরীতে হেঁটে স্বাধীনতার ১০ বছর আগে এমন চলচ্চিত্রায়ন ভাবা যায় না! সম্পূর্ন চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার পেছনে যে খামতি 'মুক্তি'তে রয়েছে, ‘উদয়ের পথে’ ছবিতে তা নেই। আমি কম করে ১০ বার দেখেছি ‘উদয়ের পথে’। যতবারই দেখেছি ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। এতোটুকু গোঁজামিল চোখ পড়েনি। ছবির চরিত্র নির্বাচন ও উপস্থাপনা এককথায় অনবদ্য।
তখন কোনো ছবিতে নায়ক নায়িকা বা কোনো চরিত্রের মুখে গান থাকলে তাকেই গাইতে হতো। লিপ মেলানোর ব্যাপার বিশেষ ছিল না। এ ছবিতেও তাই নায়িকার ভূমিকায় গান গাওয়ার জন্য অভিনেত্রী হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল বিনতা বসুকে। কিন্তু আমার মতে গানে উনি যতটা পারদর্শী, সুরেলা মিষ্টি গলায় মন ভরিয়ে দিয়েছেন, অভিনয়ে ততটা পারেন নি। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা, সততার কোনো তুলনাই হবে না, কিন্তু চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ও বাচনভঙ্গি ততটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারেনি বলে আমার মনে হয়েছে। আমার মতে সারা ছবির যদি কোনো দুর্বলতার জায়গা থাকে তবে ওটাই। রাধামোহন ভট্টাচার্য, দেবী মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ ভাদুড়িদের মতো সে যুগের তাবড় অভিনেতাদের পাশে বিনতা দেবীকে কিছুটা ম্লান লেগেছে। আসলে বোধহয় সে যুগে মহিলারা খুব স্বচ্ছন্দে সিনেমায় অভিনয় করতে পারতেন না। সামাজিক বাধা টপকে যাঁরা অভিনয়ে আসতেন বা কিছু ছবিতে সুযোগ পেতেন তাঁদের খামতিটা এ ভাবেই ধরা পড়তো।
প্রথম দৃশ্যে ক্যামেরাকে ধরা হয়েছে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়ায় চড়া কোনো এক বীরপুঙ্গবের স্ট্যাচুর অনেক ওপর থেকে (পরবর্তী কালে ওই স্ট্যাচু সরিয়ে ওখানে সুভাষ চন্দ্র বসুর স্ট্যাচু বসানো হয়েছিল)। যাই হোক, ওই অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরা ধরে কোনো 'কমার্শিয়াল' ছবি শুরু হচ্ছে, আমার জানা নেই। স্ট্যাচুর ওপর থেকেই দ্যাখা গেলো পাঁচ মাথার মোড়ের এঁকে বেঁকে চলা রাস্তা। একটা সাদা প্রাইভেট গাড়ি গলি দিয়ে চলেছে। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় ও গলি, সুতরাং উত্তর কলকাতা হওয়াই স্বাভাবিক। খুব সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির সামনে দাঁড়ালো গাড়িটি। নামল দুজন তরুণী। সহপাঠি বান্ধবীর বাড়িতে এসেছে বিশাল বড়লোক বাঙালি শিল্পপতির কন্যা গোপা। বান্ধবী সুমিতা তাকে যে ঘরটিতে নিয়ে গেল সেটি তার দাদার। দেওয়ালে আঁকা রয়েছে অপটু হাতে মার্কস, এঙ্গেল, বঙ্কিমচন্দ্র, বার্নাড শ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ'র ছবি। এমন ঘরে এ ধরনের ছবি দেখে গোপা অবাক হলো। তার স্ট্যাটাসের বাইরের অপরিচিত জগত। বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করলো, 'এ সব কী?'
গোপার বান্ধবী সুমিতা উত্তর দিল, 'ছবি'।
'ছবি তো বুঝলাম, আঁকল কে?'
'দাদা'।
'ভাগ্যিস ছবির তলায় নাম গুলো লিখে দিয়েছেন।
'তোর দাদার কি মাথাখারাপ?'
বান্ধবী সুমিতা'র মুখ গম্ভীর হলো। গোপা সেটা লক্ষ্য করে বললো, 'না ভাই কিছু মনে করিস না, আমি কিছু ভেবে বলিনি!'
'দাদা পাগল কী না জানিনা, তবে রাম শ্যাম দশজনের মতো স্বাভাবিক যে নয় সেটা সত্যি! ছাপানো ছবি তিনি ঘরে রাখা পছন্দ করেন না। মনীষীদের তো নয়ই। তিনি বলেন, তাতে চেহারার আদলটাই থাকে, মানুষের পরিচয় কিছু থাকে না। শিল্পীদের আঁকা ছবি কেনার ক্ষমতা তো আমাদের নেই! যদি কখনো হয়, তবে তাঁদের এক একটা ছবি থাকবে এক একটি দেওয়ালে।'
একেই কি বলে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দ্যাখা? শুধু স্বপ্ন দ্যাখা তো নয়। কত উন্নত রুচিবোধ দেখুন! ক'জন শিল্প রসিক এক একটা দেওয়ালে এক একটা ছবি রাখার কথা ভাবতে পারেন? ভাবতে পারেন এমন করে শিল্পকে মর্যাদা দিতে? ক'জন শিল্পীই পারেন এমন ভাবতে? প্রদর্শনী হলে গিয়ে সাধারণত কী দেখি আমরা? একটা ছবির থেকে আর একটার দুরত্ব কখনো কখনো ৫/১০ ইঞ্চি। এ যে দর্শকের চোখের ওপর কী অত্যাচার তা চোখের কারবারি শিল্পীরাও ভেবে দ্যাখে না? যেন হল ভাড়া নেওয়া হয়েছে, কড়ায় গন্ডায় পুষিয়ে নেওয়া! যাক, সে সব অপ্রিয় কথা!
এবার সুমিতার 'রাম শ্যাম'-এর বাইরের দাদা সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। নাম অনুপ চৌধুরী। পদবী দেখেই বোঝা যায় খুব যা তা পরিবারের নয়। যা তা নয়, মানে, আদক, দিণ্ডা, সাঁতরা, মাইতি গোছের নয়। যে পদবী শুনলে শহুরে বাবুরা আগে ভাগেই তাকে গাঁইয়া শ্রেণিতে ফেলে দেয়। ঠিক সেখান থেকেই চলে তার বিচার বা মানন্নোয়ন! খুব কঠিন লড়াই করে, নিম্ন-বংশ-মর্যাদার ইতিহাস ম্লান করে শহুরে বাবুদের সঙ্গে যুঝে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় এদের। এমন দুর্ভাগ্যজনক পদবীধারী যে কোনো প্রতিষ্টিত ব্যক্তির ইতিহাস জানুন, দেখবেন কত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করে শহরে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়েছে, হচ্ছে! যাই হোক, অনুপ চৌধুরীকে সে অপমান বোধহয় সহ্য করতে হয়নি। চক্রবর্তী, ব্যানার্জী, মুখার্জী না হোক চৌধুরী তো! তাই বা কম কী? কালের ফেরে সে আজ গরিব হলেও বংশ মর্যাদায় সে গরিব নয়। তার শিক্ষা, বাচন, ব্যবহারও সে কথা বুঝিয়ে দ্যায়। বিভিন্ন পত্র পত্রিয়ায় লেখালেখি করে সামান্য তার উপার্জন। তা দিয়েই মা ও এক বোন'কে নিয়ে সাধারণ এক বাড়িতে ভাড়ায় থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই নিয়মিত ভাড়া দেওয়া সম্ভব হয়না। কখনো লুকিয়ে থাকতে হয়। চরিত্রটির সঙ্গে পরিচয় হলেই বোঝা যাবে কেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তার লেখা বেরোলেও তারা এতো গরিব। কারণটা খুবই স্পষ্ট। যে লেখা লিখলে মানুষ গোগ্রাসে গেলে, তার রসদে গাড়ি বাড়ি হাঁকানো যায়। একপাল চামচা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। সে গোত্রের লেখক অনুপ চৌধুরী নয়। তার সঙ্গে একজন আদোপান্ত সৎ মানুষ। একটা আদর্শ বোধ বিরাজ করে তার ভেতর। উপকার বই কারো অপকার বা অনিষ্ঠের কথা ভাবতেই পারে না। অসম সাহসী। উচ্চশ্রেণির যত বড় কেউকেটা হোন, মুখের ওপর স্পষ্ট বা উচিৎ কথা বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। কখনো কখনো উৎকট মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, ঢ্যাঁটা লোক। বড় বেশি ন্যায় নীতি পরায়ন। আসলে এমন ভাবনা বোধহয় আমাদের শ্রেনিগত অবস্থান থেকে। আমাদের মধ্যেও তো বাসা বেঁধে রয়েছে শ্রেনি সংস্কার। রিক্সাওয়ালা, কুলি মজুর হঠাৎ ন্যায়ের কথা মুখের ওপর শুনিয়ে দিলে আমরা কী নিতে পারি? ঢ্যাঁটা, বা তর্কবাজ বলে গাল পাড়ি না? প্রকাশ্যে বা মনে মনে?
অনুপ চোধুরীর একটা ঘটনার কথা বলা যাক। এক নিকট বন্ধুর সন্ধান দেওয়া চাকরীর জন্য বিরাট এক শিল্পপতির অফিসে বসের সঙ্গে দ্যাখা করতে গেল অনুপ। ভিজিটিং কার্ডে নাম লিখে, টেলিফোনে নানান ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে বসের সামনে উপস্থিত হলো। ভিজিটিং কার্ডে অনুপের নাম দেখে বস বললেন,
'শ্রী অনুপ লেখক'। লেখক বলে কোনো পদবী কখনো শুনিনি তো!'
অনুপ জবাব দিল, 'ঘটক হতে পারে, পাঠক হতে পারে লেখক হতে দোষ কী? গুপ্ত, বোস, চৌধুরী হলে তো বোঝা যাবে না আমি কী করি। তাই লিখি লেখক।'
'ও! তা নামের আগে অতো বড়ো শ্রী জুড়েছেন কেন? তারও কী একটা তাৎপর্য আছে নাকী?'
'আছে বৈকী! জীবনের কোনো জায়গাতে তো আর শ্রী নেই। শ্রীটুকু শুধু টিকে আছে নামের আগে। তাই ওটা বড় করে লিখি আর জোর করে উচ্চারণ করি।'
বসের ঘরে ঢোকার পর থেকেই অনুপ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। যে কারণেই হোক বস বসতে বলেন নি। অনুপ নিজেই বলল, 'বসতে বলবেন বলে তো মনে হচ্ছে না। বসতে পারি কি?'
বসার অনুমতি পেয়ে সে সামনের চেয়ারে বসলো।
বস জিজ্ঞেস করলেন, 'কী চাই আপনার?'
'চাকরী, শুনলাম প্রচার কাজের জন্য একজন কর্মচারী চাইছেন'?
'উপস্থিত কী করেন আপনি?'
'পদবীতেই বলা হয়েছে।'
'না, আমি জিজ্ঞাসা করছি কাজকর্ম কী করা হয়?'
'আপনি জানতে চাইছেন তো, আমার অন্ন বস্ত্র জোটে কি করে? লিখে যা আয় হতে পারে, সে তুলনায় আমার পোষাকটা কি বড় বেশি উঁচু দরের মনে হচ্ছে? তা আমার ভাগ্য ভালো। এটা কিন্তু আমি বজায় রেখেছি, লিখে যা পাই তাই দিয়ে।'
বস একটু গম্ভীর হলেন, 'আপনার কথাবার্তা শুনে মনে হয়না আপনি চাকরির উমেদার হয়ে এসেছেন। আপনি এসেছেন এমন একটা ভাব নিয়ে, হলে হলো, না হলেও চলবে।'
কী, লোকটাকে একটু ঢ্যাঁটা মনে হচ্ছে না? প্রতি পদে পদে ঢ্যাঁটামোর অজস্র নমুনা রয়েছে সারা ছবি জুড়ে।
গোপা নিজে এসে বান্ধবী সুমিতাকে ভাইজির জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছে। কিন্তু কী উপহার দেবে সে? কী দেওয়ার সামার্থ রয়েছে তাদের? সুমিতা নিজের হাতে গোপার ভাইঝির জন্য একটা ফ্রক বানাতে শুরু করলো। দাদা দেখে জিজ্ঞেস করলো, কী রে ওটা? ফ্রক তৈরির কারণ জেনে ও তৈরি হওয়া ফ্রক দেখে বলল, 'বাঃ চমৎকার হয়েছে, কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, ওখানে এর কোনো সমাদরই হবে না। ওরা দেখবে কোনটা কত দামে ভারী!'
সুমিতা বলল, 'সব বড়লোক তো আর একরকম নয় দাদা!'
'এক রকম। অর্থহীন লোক সম্পর্কে ওরা সবাই এক রকম। যেটা কে তোরা বলিস ভালো ব্যবহার, সেটা হলো করুণা। সেটা আরো অসহ্য!'
'কিন্তু গোপার সঙ্গে পরিচয় হলে তুমি এসব বলতে না। বড়লোক বলে দেমাক ওর সত্যিই নেই।'
সত্যিই গোপার দেমাক নেই। বিশাল শিল্পপতির কন্যা। অল্প বয়েসে মা'কে হারিয়েছে। বর্তমানে তার বাবা বাইরে, তাই তার দাদা ম্যনেজিং ডিরেক্টরের কাজ সামলাচ্ছেন। সেই দাদার একমাত্র কন্যার জন্ম দিন। বলাই বাহুল্য সমস্ত গন্য মান্য ধনীরা আমন্ত্রিত। গোপার আদর্শ বোধ শিক্ষা ও বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা বান্ধবী সুমিতাকে নিমন্ত্রণ করেছে। নিজে গাড়ি পাঠিয়ে সুমিতাকে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বান্ধবী যে শ্রেণির, তার চালচলন, পোষাক তো আর আভিজাত্যপূর্ণ নয়! বড় বেমানান এই আসরে। বৈঠকখানায় প্রবেশ করতেই সবাই আড়চোখে তাকালো। কেউ কেউ সরেও বসলো। গোপা কাজে ব্যস্ত, ফলে বান্ধবীর এই অস্বস্তিকর অবস্থা চাইলেও কাটানোর উপায় ছিল না তার। সুমিতা নিজেও বুঝল এ আসরে সে বেমানান। কিন্তু সে তো আর ছুটে পালাতে পারে না। গোপার ভালোবাসা, আন্তরিকতার কোনো খেদ তো সে লক্ষ্য করেনি! বুঝল তার দাদার কথাই ঠিক, 'ওরা দেখবে কোনটা দামে ভারী'! এতো দামী দামী উপহারের আলোচনা চলছিল তার মাঝে গোপার নিজের হাতে করা সামান্য উপহার এখানে যে বিন্দুমাত্র মর্যাদা পাবে না তা সে বুঝেছিল। তাই কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে ফেলল তার তৈরি করা ফ্রক। যা গোপার ভাইঝির জন্য উপহার হিসেবে এনেছিল।
একসময় গোপা বান্ধবীর পরিচয় দিয়ে সুমিতাকে পিয়ানোর কাছে নিয়ে গেল। তাকে গান করতে বলল।
সুমিতা বলল, 'কী গান গাইবো?'
'তোর যা ইচ্ছা তাই গা'।
সুমিতা গান ধরলো....
"গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই,
গানের এই অগ্নিমালা দেবতারে খুঁজে না পাই।
নিশিদিন পায়ে যাদের শিকল বাজে,
তারা যে বন্দী সবাই নিজের মাঝে।
তারা যে জীবনতরী নকল সোনায় করলো বোঝাই।"
বলাই বাহুল্য এমন ভাষার গান সমাজের ওপর মহলের নানুষদের ভালো লাগার কথা নয়। অনেকেরই ভ্রূ কোঁচকালো। কেউ কেউ মুখ চাওয়া চায়ি করলো।
আসলে এই গানটা সুমিতার দাদার খুব প্রিয়। প্রায়ই সুমিতাকে গেয়ে শোনাতে হয়।
এর পরই ঘটল চরম একটা ঘটনা। সুমিতা আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল যে উপহার সেটা কীভাবে যেন টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানোর সময় পড়ে গিয়েছিল। পাছে কেউ দেখে ফ্যালে, সুমিতা তাড়াতাড়ি সেটা আঁচলের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে নেয়। গোপার বৌদির চোখে পড়ে যায় মুহূর্তটা। সুমিতা কিছু একটা আঁচলে পুরেছে।
গোপাকে পাশের ঘরে ডেকে ঘটনাটা জানাল, 'তোমার ওই সুমিতা, টেবিল থেকে কিছু একটা চুরি করেছে।'
'কী বলছো?'
'হ্যাঁ, টেবিল থেকে কী একটা আঁচলের আড়ালে রাখলো। আমি স্বচক্ষে দেখেছি'।
'ছিঃ বৌদি, ও শুনতে পাবে। এদিকে এসো।'
যদিও ততক্ষনে পাশের ঘরে থাকা সুমিতার কানে চলে গিয়েছে এই মারাত্মক অপবাদ। কানে যেতেই মাথা ঘুরে সুমিতা অজ্ঞান হয়ে গেলো।
একটু ডিটেলে ঘটনাটা বললুম কয়েকটা কারণে। প্রথমত উচ্চ ও নিচু শ্রেণির বৈপরীত্য বোঝানোর জন্য এ ঘটনাটা যথেষ্ট। পুরো ছবিটার সুরই যেন ধরা হয়েছে এই দৃশ্যে। দ্বিতীয়ত সুমিতার দাদা এতো বোঝে সুমিতার তৈরি করা সামান্য ফ্রক বড়লোকের বাড়িয়ে সমাদৃত হবে না। তাহলে বোনকে অমন একটা গান গাওয়ার অনুমতি দিল কেন? সুমিতা দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিল, জন্মদিনের আসরে কোনটা গাইবে? এই গানটা কী? দাদা অনুমতি দিয়েছিল। অনুপ তো ভালো করেই জানে এ গানের ভাষা বড়লোকদের জাত্যাভিমানে আঘাত করবে! তাহলে সে কি জেনে বুঝে অনুমতি দিয়েছিল? কোথাও বড়লোকদের ওপর আঘাত হানার অভিপ্রায়ে? সুযোগের সদব্যবহার?
তৃতীয়ত ১৯৪৪ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রায়নে এতো নিখুঁত চিত্রনাট্য। এতো বিশ্বাসযোগ্য করে চিত্রায়িত করা কি করে সম্ভব? সামান্যতম গোঁজামিল বা অবাস্তবতা নেই।
চতুর্থত, প্রথম দৃশ্যে দেওয়ালে আঁকা মনীষীদের ছবি, যাঁদের মধ্যে মার্কস-এঙ্গেলসও রয়েছেন। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে এমন একটা গান ঢুকিয়ে দেওয়া, কমিউনিস্ট ভাবধারার নয়?
পরবর্তী পর্যায়ে জানা যাবে আসলে অনুপ শুধুমাত্র লেখক নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতায় সে বস্তির মানুষদের দুঃখ কষ্ট, অভাব অভিযোগ কাছ থেকে দ্যাখে। সাধ্যমত সমাধানের চেষ্টা করে। কারখানার কর্মীদের অভাব অভিযোগ নিয়ে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগবদ্ধ করে। সিনেমায় ট্রেড ইউনিয়নের আবির্ভাব বোধহয় বিমল রায়ের এ ছবিতেই প্রথম। কিন্তু একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অনেক সময় বজ্রকঠিন পাথরের মতো। এমন পরিচয় আমরা অনেক পেয়েছি। অনুপ কিন্তু তা নয়। হয়তো প্রথম জীবনে ছিল, গোপার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আর তা থাকেনি। একজন মানব দরদী প্রেমিক হয়ে উঠেছিল।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, নিজের জীবন যাকে কাঁদায় না সে মানুষের জন্য কাঁদতে পারে না! কাঁদলেও সে কান্না মানুষের কোনো কাজে আসে না। প্রেম, ভালবাসাই শেখায় মানুষের পাশে থাকতে, ভালোবাসতে। প্রেমহীন মানুষ স্বার্থপর। নিজের ছাড়া কিছু বোঝে না! অনুপের প্রথম জীবনের কর্ম আর প্রেমে পড়ার পর মানুষের জন্য আত্মত্যাগের অনেক তফাৎ। গোপার প্রেম প্রতিনিয়ত তাকে শক্তি দিচ্ছে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আবার গোপার সরে যাওয়া বা সরে যেতে বাধ্য হওয়া অনুপের সমস্ত শক্তি ক্রমশ হীন হতে থাকলো। যেদিন অনুপের কানে গেলো, গোপা তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তার বিয়ে এক মস্তবড় ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। অনুপের এতো দিন মানুষের পাশে থাকার শক্তি যেন হারিয়ে যেতে থাকলো। কোথায় যেন গোপার ভালোবাসা আড়াল থেকে তাকে প্রেরণা দিচ্ছিল। তার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে সে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ? গোপার দূরে সরে যাওয়ার সংবাদ তাকেও যেন দূরে সরিয়ে দিতে চায়। মা বোনকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে নিজেও চলল পরবাসে। যাওয়ার আগে নিজের আঁকা মার্কস-এঙ্গেলস, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের ছবি শুধু মুছলো না। তার ঘরের দরজায় ঢুকে যে লাইনটা প্রথম সবার চোখে পড়ে, প্রথম দিন তাদের বাড়িতে এসে গোপারও চোখে পড়েছিল, "উদয়ের পথে শুনি কার বানী ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ কে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।"
লাইনটা নিজের হাতে মুছে দিলো অনুপ।
কিন্তু কী হলো তার পর? গোপা কি আভিজাত্যের শিকল ছিঁড়ে অনুপের হাত ধরে শুরু করলো নবজীবনের গান? হাত ধরাধরি করে দুজনে পথে নেমে মানুষের পাশে দাঁড়ালো?
তত্ত্ব কথায় যাবো না। শুধু বলি 'উদয়ের পথে' না দ্যাখা ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসকে যেন অস্বীকার করা। খুবই সহজলভ্য এ ছবি। বর্তমানে এ ছবি ইউটিউব সার্চ করলেই পাওয়া যাবে। ভারতীয় তথা বাঙালি হিসেবে না দ্যাখা এককথায় অন্যায়।
সবাইকে নমস্কার জানিয়ে 'বিষয় চলচ্চিত্র' বিভাগ থেকে আপাতত বিদায়। সবাই ভালো থাকুন।
চমৎকার লেখা, চলচ্চিত্র টি দেখার উৎসাহ বাড়ালো
ReplyDelete