অনুপম – কবি কি আদৌ
সচেতন হতে পারেন যে, তিনি একটা নতুন ভাষা সৃষ্টি করতে চলেছেন? যখন তিনি কৃতসংকল্প,
নতুন ভাষায় কবিতা লিখতে যান – যদি তাঁর সন্ধান হয়ে ওঠে নিজের ভেতরে ডুব দেবার জন্য
আনকোরা নতুন কোনো ডুবুরীর পোশাক- সেই নতুন কি কোনোভাবে আঘাত দেয় কবিতার সনাতন পাঠককে,
কিংবা, স্বয়ং কবিতাও কি হয় আহত?
অমিতাভ – সূচের মতো
তীক্ষ্ণ, যন্ত্রণাযুক্ত এবং সূক্ষ্ম উদ্ভাসনের উপযুক্ত এক অসহ্য ভাষা – এই তো কবির
আছে অনুপম। তিনি এক অলৌকিক কে বুনে যাচ্ছেন শুধু এটুকুর সাহায্যে। মাঝে মাঝে সেই
ভাষা সূচের মতো একটু বিঁধে যায় আঙুলে। মহাকাশের মতো বড়ো আঙুলে একফোঁটা রক্তের
দাগের মধ্যে কোথাও যেন সূর্য ডুবে যায়। কবিতা ধরে রাখে একটু নিভৃত আড়ালে, এই ডুবে
যাওয়া সূর্যের মুহূর্ত।
কিন্তু আঙুল নিজেই যদি এভাবে একদিন সূচ হয়ে
ওঠে? একটা সূচ তখন কি অন্য সূচে বিঁধে যাবে/ যদি বিঁধে যায়, আঙুল তখন আর মহাকাশ হয়ে
উঠবে না! একফোঁটা রক্তের দাগে সূর্যস্নানের দৃশ্যও খুঁজে পাওয়া যাবে না আর। সূচের
তো যন্ত্রণার অনুভূতি নেই, কি দেবে সে কবিকে?
এক ক্রমজায়মানতা আছে ভাষার নিজেকে ভেতর
থেকেই সে নিজেকে সে ধায় গতিতে বদলে নেয়। জোর করে, এটা করতে গেলে সেটা অ্যাবরট করা
হয়, যা স্বাভাবিক নয়, বিহারীলাল চক্রবর্তীর সময়ে কোনো দুঃস্বপ্নেও কি লেখা হতে
পারত ফাল্গুনী রায়ের কবিতার মতো কবিতা? ভাষা একধরনের Harmless
Enigma । তাকে বিস্তার দিয়ে নতুন করে তোলার চেষ্টায় আমরা প্রলাপ করে
তুলছি সেই ভাষাকে। উমাবার্তো ইকো-র লেখা থেকে একটি মাত্র শব্দ সরিয়ে দিয়ে যেটা
এইমাত্র বললাম, তার জন্য তুমি কি শাস্তি দেবে আমাকে?
অনুপম – অথচ ভাষাই
রাষ্ট্র, ভাষাই অঞ্চল, একটা মানুষের সঙ্গে আরেকটা মানুষের পার্থক্য, যদি কিছু
থাকে, তা শুধু ভাষার। আপনি অমিতাভ মৈত্র, কারণ আপনার ভাষা অমিতাভ মৈত্র, এবং আমি
অনুপম মুখোপাধ্যায়। একেক সময় এই পার্থক্য ঘাতকও হয়ে উঠতে পারে। enigma থাকলেই তার প্রতি একটা দ্রোহও থাকে, যেন দারা সিং দুহাতে বাঁকিয়ে নেবে
জেলখানার গরাদ, যখন, ক্যামেরার বাইরে কোনো গরাদ অথচ নেই, বেরিয়ে পড়বে অগণিত
কনস্টেবলের বন্দুক পেরিয়ে, অথচ, বন্দুকের আওয়াজগুলো পরে তৈরি করাই হয়েছে। জেলখানার
পাঁচিলে উঠে একটা লাফ দিলেই মুক্তি, এবং প্রতিশোধ। পাঁচিলের ভিতরে কোনো ভিলেন নেই,
এবং, বাইরে কোনো শ্বাসকষ্ট নেই, আবার, হয়ত, পাঁচিলটাও নেই।
অমিতাভ – ঠিক তবে
আমার মতো পাতি মানুষ কিন্তু চাইবে এই Enigma থাকুক, মুক্তি
না এলেই ভাল এর থেকে যে কষ্ট ও মনস্তাপ আমারই সৃষ্টি, আমার থেকেই যার উৎসৃজন, তাকে
এড়াতেই তার আক্রমণ থেকে বাঁচতেই আমি বৃহত্তর ও মহৎ কোনো মুক্তির খোঁজ করছি না তো!
যার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই নিজেকে সুন্দর করে দেখা ও দেখানো, গায়ে কম্বল জড়িয়ে
আগুন লাগিয়ে দিলে, সে কিন্তু গালে ব্রাশ লাগিয়ে ব্লেন্ড করে, মসৃণ হাইলাইট দিয়ে
মুখে গ্লো আমার কথা ভাববে না। নার্সিসাস আত্মরূপে ডুবে থাকতে পেরেছিল যেহেতু তার
সামনে ছিল জল। জলের বদলে আগুন থাকলে নার্সিসাসের আর নার্সিসাস হয়ে ওঠা হয় না। যে
সব নারীরা তাঁর থেকে প্রত্যাখ্যানে পেয়েছে, তারা যদি সামান্য একটা জ্বলন্ত মশাল
তাঁর শরীরের খুব কাছে নিয়ে আসত, কে বলতে পারে নার্সিসাস একজন মিস্টার জুয়ান হয়ে
উঠতেন না?
অনুপম – হা হা হা
হা ... আলফ্রেড হিচককের ‘সাইকো’ সিনেমার সেই মা, যার ছেলে মানতেই চায়নি মায়ের
মৃত্যু, মানতেই পারেনি কোনো নারী তার সামনে কাপড় খুলে স্নান করবে? কী যত্নে মায়ের সেই
মৃতদেহকে রাখা হয়েছিল! বেশ সাজগোজ ছিল কিন্তু! এটাই হয়ত কিছু কবিতার ভয়াবহতা। এবং,
নিজের অজান্তেই একটা হরর সিনেমার মধ্যে পাঠক ঘুরে বেড়ান, যেন কোনো ঝামেলা নেই, যেন
দুপুরের রোদে শুয়ে থাকা শাদা কবরখানা, বেগুনি, লাল, হলুদ রঙের হাল্কা ফুলে ছেয়ে
আছে...
অমিতাভ – তার আগে ,
অনুপম একটা কথা জিগ্যেস করি তোমাকেই। তোমার কি মনে হয় না, অনেক কবিতাকেই একধরনের
সাপোর্ট দিয়ে সম্পূর্ণ করতে চেয়ে আমরা ভেন্টিলেশানে রাখি। যেন এভাবেই তাকে আরো
একটু উপস্থাপনের যোগ্যতা দেওয়া যাবে। আমার তো মনে হয় আমাদের প্রত্যেকের চিন্তায়
একটা প্যাটার্ন তৈরি হয়ে যায়। জেনে বা না জেনে আসলে আমরা সেই প্যাটার্নের দাসত্ব
করে চলি তখন। এই ব্যাপার টাকেই একটু আগে ভেন্টিলেশন বলছিলাম।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment