।। বাক্‌ ১২২ ।। জ্যোতির্ময় বিশ্বাস ।।






আজ একেবারে সেই ভোর পাঁচটা থেকে চোখদুটি খোলা.. তিমির মনে মনে এরকম করে ভাবতে লাগলো আজ, ভোর পাঁচটা নাগাদ থেকে ওর চোখ দুটো নাগাড়ে পরিশ্রম করে চলেছে এখন বিকেল, রীতিমত কপালের দুপাশ ব্যথা করছে মাঝে ঘুম পেয়েছে একবার, কিন্তু ঘুম তার চোখে একটু ভালো করে জুড়ে বসতে চাইলেই ভয়ে সে চোখ...উহু, সবাই যেমন জানে, ভয়ে চোখ বুজে ফেলা হয়, এক্ষেত্রে কেস উল্টো, ভয়ে এই গল্পের (বা, সত্যের) নায়ক তিমির চোখ খুলে ফেলে আরো নির্নিমেষ আরো অপলকভাবে চেয়ে চেয়ে থাকে ভীষণ সন্ত্রস্ত হয়ে একা এই গিলান্ডি নদীর পারে ভুতেরহাট গ্রাম; সেই গ্রামে তার ওই টিনের ছাপড়া ঘরবাড়ি বাবার সঙ্গে থাকে ও, তাছাড়া কেউ নেই মা ছোটবেলায় প্রয়াত আচ্ছা, ওকে কি চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না? আস্তেহ্! শব্দ করবেন না...বলছি তবে বলার আগে বলে নিই আমি হলাম এই গল্পটির ন্যারেটর, ভারতবর্ষস্থিত পশ্চিমবঙ্গের এক শীর্ন শাখানদী গিলান্ডি, তাঁর কূলে এক অভিজ্ঞ শিমুল গাছ মনে মনে আপনি আমায় যে কোনো প্রদেশের যে কোনো গাছ হিসেবে ভাবতে পারেন, আপনার ভাবনার সুবিধামত তবে এই গল্পে, এখন, আমি শিমুল বলছি

তো, প্রশ্নগুলো ছিলো এই যে ইদানিং তিমির কেন এতবেশিক্ষণ ধরে অপলক চেয়ে থাকে; তিমির কেন চোখ বুজতে ভয় পায়, চোখবোজা অন্ধকারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারেনা, তিমির কেন সদা এত সাবধান কাজকর্মে মন নেই, কী এত ভয় ওর? একটা সামান্য বিষয়ে ও একটু বেশিই প্যানিক করছে বলে মনে হচ্ছেনা? আচ্ছা, তো সামান্য বিষয়? না না বলি লে নেয়া যাক

কিছুদিন আগে সে মোবাইলে একটা ভিডিও দেখে বা দেখে ফেলে ফেসবুকে ফেসবুকে একটা নিউজপেজে কি একটা দেখার জন্য সে ক্লিক করেছিলো সেই ভিডিওটা শেষ হতেই আরেকটা অটোমেটিক শুরু হয়ে গেল এবার সেই ভিডিওটা যা দেখালো তা এই : একটা স্কুটার থামার আওয়াজ দেখা গেলো সেই স্কুটারটা থেকে কালো জ্যাকেট পরা একটা রোগা মতো যুবক, তিমিরের নিজের থেকে অন্তত ৬/৭ বছর বড়ো মনে হলো, নেমে, স্কুটার থেকে নেমে সামনের দিকে যে অল্পব্যবহৃত প্রয়ান্ধকার জঙ্গুলে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, সেইদিকে হাঁটা দিলো আর ঠিক পেছনে আরেকজন লোক, তার পরনে লাল একটা জামা গলায় স্কার্ফ জড়ানো সাদা প্যান্টে জামাটা ইন করা এই লোকটা স্কুটার থেকে অনেকটা নৌকার নোঙড়ের মতো দেখতে একটা কুড়ুল বের করে হাতে নিয়ে কালো জ্যাকেটের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো অলরেডি ভিডিওক্লিপটার সেকেন্ডকয়েক অতিক্রান্ত এবং এতটুকু অব্দি সব ঠিকঠাক তিমির বুঝতে পারছেনা এ ভিডিওটার বিষয়বস্তু কী হঠাৎ, লালজামা পরা লোকটা করলো কি; তার হাতের সেই কুড়ুলের বাটটা দিয়ে সামনের সেই কালো জ্যাকেট পরিহিতের মাথার পেছনেঠাস্!” রে বিরাট বীভৎস একটা আঘাত করলো! গায়ে যত জোর ছিলো সবটা প্রয়োগ করে সঙ্গে সঙ্গে কালো জ্যাকেট আঁতকে উঠে ছিটকে হুমড়ি দিয়ে সামনে পরে গ্যালো!
এদিকে তিমির, সে তো কল্পনাই করতে পারেনি ওই ভিডিওটা ওরকম টার্ন নেবে ওরও মাথার পেছনে যেন হাজার ভোল্টের শক লাগলো! তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলো সেখান থেকে নিজেকে ছিন্নভিন্ন লাগছে ওর, এটা কী! আর কেন!
সারাটাদিন ও রাত তিমির আর ফেসবুক খোলেনা মাথা ঝিমঝিম করে কথা বলতে ভালো লাগেনা


এখানে বলে রাখা থাক যে তিমির ফেসবুকে বছরখানেক ধরে থাকলেও, বিশ্বের কথা তো দূর, দেশের তথা ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি কোনোপ্রকার অবস্থা সম্পর্কেই সে সচেতন নয় সে জানে দেশের প্রধানমন্ত্রী এখন অমুক পার্টির অমুক আর রাজ্যের ক্ষমতায় এখন কোন পার্টির কে, সেটাও জানা তার নিজের এলাকায় যাদের দাপট তাদের সঙ্গে ওর বাবার ভালো সম্পর্ক এসব এটুকু মধ্যে ও থাকে পড়াশোনা জুড়াপানি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইন অব্দি তাও পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেলো ও লাস্ট ইস্কুলে গেছে এখন ওর বয়স ২১ মতো বয়স বাবাকে জমির কাজে অল্পবিস্তর সাহায্য করা ছাড়া কিছু করা নেই ওর যাইহোক,  একদিন ন্যাংটাকালের বন্ধু, পুণ্ডীপাড়ার গৌতম ওর ফোনে ফেসবুক জিনিসটা খুলে তিমিরকে দেখায় তাতে চেনা অচেনা সুন্দর অল্পসুন্দর সব মেয়েদের ছবি ইত্যাদি তিমিরকে দেখিয়ে সে পুলকিত হয় এই নিয়ে মাঝেমাঝে দুজনে মাততে লাগলো আর সেইসঙ্গে কয়েকটা সস্তা জোকসের পেইজ, এই এছাড়া ফোনে গৌতম ওকেপানুও দেখায় ধুধু গিলান্ডির পারে কলাবাগানে বসে ফুল সাউন্ডে ওরা পানু দেখে
মাসদুয়েক হলো তিমিরের নিজের ফোন হয়েছে একটা বিশেষ সিমকার্ড, সস্তায় অনেক নেট করা যায় গৌতম ওকে ফেসবুক খুলে দিয়েছে তিমির না বুঝে স্ক্রল করে যায় যা ইচ্ছে দেখে বাবার কাজে কম সাহায্য করা হয় বকাও খেতে হয়
তারই মধ্যে একদিন এই ঘটনা



কিন্তু অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটলো সাতদিন পরে একদিন বিকেল চারটে নাগাদ সাইকেলে তিমির বাড়ি ফিরছে বাজার থেকে একটু দেরি হয়ে গেছে, বাবা ওকে সাড়ে তিনটার মধ্যে বাসায় ফিরতে বলেছিলো কি একটা কাজ যেন আছে সম্ভবত ভুট্টা ভাঙিয়ে ছাতু বানিয়ে আনতে বলবে ভুতেরহাট বাজারে সুবল দাসের মিল থেকে ইতিমধ্যে তিমির ফেসবুকে দেখা সেই ভিডিওর ট্রমা অনেকটা স্তিমিত কিন্তু সেদিন, বড় রাস্তা ছেড়ে বাড়ি ঢোকার জন্য ওদের যে গলিটা, তার মুখে ও থমকে গিয়ে সাইকেলে ব্রেক কষলো একেবারে অবিকল, হুবহু!! সেই ভিডিওয় সেই অল্পব্যাবহৃৎ, প্রায়ান্ধকার যে জঙ্গুলে রাস্তাটা তিমির দেখেছিলো, ওদের গলির মুখটা যেন তারই জমজ জায়গা! বুকটাঢিপ!’ রে উঠলো ওর ভয়! যেন বোতলে থিতিয়ে থাকা কাসুন্দি সামান্য অথচ মোক্ষম এক দুলুনি দিয়ে কে নেড়েঘেঁটে দিলো এ কি ভুল দেখা? উহু, তাই বা কেমন করে হয়! তিমির ভাবে, কিন্তু এ একেবারে একরকম, সেইম!
সেই যে ফেসবুকের ভিডিওটা যেটা ও আংশিক দেখে ছেড়ে দিয়েছিলো এবং পরের অংশটা বাজারে কয়েকজনের মুখে শুনেছিলো, সেই কালো জ্যাকেট পরা লোকটাকে নাকি কুপিয়ে পেট্রোল ছড়িয়ে তৎক্ষণাৎ আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়; আড়াই মিনিটের মতন সময় লাগে মানুষটিকে মেরে ফেলতে ,সেই না দেখে ছেড়ে দেয়া অংশটুকু, কোপানো এবং পোড়ানোর দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে যেন কয়েক সেকেন্ডের আঁচড়ে পারফর্মড হয়ে যায় চোখ বোজা মাত্র একটা লাল জামা একটা কালো জ্যাকেট একটা কুড়ুল একলাইন চিৎকারবাবুউঃ জান বাঁচাও!!”, আর দাউদাউ আগুনএইসবগুলো, তিমিরের মনে হয়, যেন নিজের বাড়ির সম্মুখেও কোনোদিন ঘটতে পারে ভেবে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা কোমল হাওয়া বয়ে যায় তিমির ইসলাম জোর করে চেয়ে থাকে অপলক, অপলকতর, সমাধিস্থের মতন জাগ্রত



তিমিরের গল্পটা শেষ নানান অন্য ঘটনায় ও অ্যাক্টিভিটিতে ওর এসব সেরে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে সেটা বাদ দিলেও আরেকটা গল্প রয়েছে, সেটা বলি ছোট্টই দেখুন আপনি জানেন কিনা জানিনা, পৃথিবীতে প্রত্যেকটা গাছের সঙ্গে প্রত্যেকটা গাছের নিবিড় যোগাযোগ আছে আপনাদের মানুষে মানুষে যত নেটওয়ার্ক যত ফোর-জি টু-জি রয়েছে সবকিছুর চেয়ে অনেকানেক গুন বেশি সক্রিয় সংযোগ সেই ভিডিওটিতে যে ঘটনাস্থল, সেখানে যেসব শিমুল পলাশ ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি রয়েছে আর তিমিরের বাড়ির গলিতে, নদী হিসেবে কৌলিন্যবিহীন এই গিলান্ডির পারের আমি ও আমরা যারা ডেউয়া হরীতকী বা বকফুলগাছ রয়েছি- আমাদের এমন চমৎকার সংযোগ রয়েছে যা মনুষ্য কল্পনাও করতে পারবেনা
আমি ঘটনাস্থলের একঝোপ দুর্বাঘাসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যেমন বাঙালি সাংবাদিকরা করে থাকেন : আচ্ছা, আপনার এত কাছে এইযে নারকীয় ঘটনাটা ঘটলো, আপনি ঠিক কী অনুভব করলেন, আপনাদের চোখের সামনে  একজন নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে এহেন নৃশংস উপায়ে হত্যা ক'রে আততায়ী তো চলে গেল...!
অভিজ্ঞ এবং নম্রভাষ দূর্বাঘাসগুলি যথারীতি শিক্ষিত উদ্ভিদের গাম্ভীর্য্যে জবাব দিলেন, "সেদিন এখান কেউ আততায়ী ছিলো না লালজামা, কালোজ্যাকেট, ক্যামেরাম্যানপ্রত্যেকেই এরা যে যার মতো ক'রে ভিকটিম আর আততায়ী ছিলো অন্য জায়গায়, দূরে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সে থাকতে পছন্দ করে"

শুনে চুপ করে রইলাম যেমন থাকি

4 comments:

  1. ভাল গল্প। তবে প্রেডিক্টেবল। শুরুতে প্রত্যাশা ছিল, একটু পরেই যেন বোঝা গেল, ঘটনার পূর্বাভাস। এবং সেই সরলরেখা থেকে ঘটনা সরল না। শেষ অংশটাও সরলীকৃত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রেডিক্টেবল, কারণ লেখক হয়তো মনের মাধুরী মেশানোর স্কোপ পায়নি। অর্থাৎ, লেখক নিজে থেকে কিছু 'ঘটাতে' পারেনি। ঘটে যাওয়া একটা কিছুই ...তবে হ্যাঁ, যখন এটাকে গল্প বলা হচ্ছে তখন এর মধ্যে পাঠক নিশ্চয় শিল্প খুঁজবে। স্বাভাবিক।

      এইরকম পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা প্র্যাকটিসকারীদের উপকার করে। ধন্যবাদ।

      Delete
  2. আমরা সকলেই নিজেদের মতন করে ভিকটিম। এইটিকে যদি রিয়ালাইসেশন বলা হয় তবে তা খুব একটা সহজ কিছু নয়। কারণ যে বৃহৎ কসমিক কোনশাসনেস যাকে আমরা বিবেক বলে থাকি তার অস্তিত্ব কিন্তু এভলুশন এর মধ্যেই পরে। তাই কেউ মৃত্যুর মধ্যে ধর্ম কে খুঁজে পায় আবার কেউ লাল জামা সাদা প্যান্ট , রাম নাম কিংবা আল্লাহু আকবর দিয়ে আর্তনাদ ঢাকবার চেষ্টা করে।
    ফিলোসফি পেলাম। মিল পেলাম।

    ReplyDelete