।। বাক্‌ ১২২ ।। অনুপম মুখোপাধ্যায় ।।





চারটে দিন বেশ ভালো কাটল। আজ কলকাতা ফিরতে হচ্ছে। মনটা খারাপই লাগছে। মাত্র চারটে দিনের জন্য হলেও নিজের একঘেয়ে বৃত্তটা ভেঙে ফেলতে পেরেছিলাম, সেটাও কোনোরকম বিদ্রোহ ছাড়াই। অন্বেষাও কিছু মনে করেনি এই কয়েকটা দিন ছেলেবেলার বন্ধুর বিয়েতে কাটাতে আসার সিদ্ধান্তে। বরং খুশিই হয়েছিল। অবিশ্যি এই চার দিন ও-ও মেয়েকে নিয়ে নিজের মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে আসবে। হুইস্কির মাত্রাটা মেনে চলতে বলেছিল। সেটা যে মানতে পারবো না অন্বেষা ভালোই জানে। কলকাতাতেও মানতে পারিনি কোনোদিন। তবে পাঁচ বছর বয়সী কন্যাটির আদেশ পালন করেছি। দিনে তিনবার ফোন করেছি ওদের।
অভিষেক তো আশাই করেনি আমি আসবো। ও বেজায় খুশি হয়েছিল। ওর বাড়ির লোকও। অভিষেকের সঙ্গে ছেলেবেলার পর এই প্রথম দেখা হচ্ছে না। ও কলেজের পড়াটা কলকাতাতেই করেছে। আমরা দুজনেই প্রেসিডেন্সীর ছাত্র। তবে অন্যান্য ছেলেবেলার বন্ধুরাও দেখলাম আমাকে ভোলেনি। প্রণব, শুভময়, সুদীপ্ত, সায়ন্তন অনেকের সঙ্গে দেখা হল। সকলের চোখেমুখেই পুরনো আদলটা কিছুটা হলেও এখনও চেনা যায়। তপন বাচ্চাদের ডাক্তার হয়েছে। সে তো জড়িয়ে ধরে চুমু-টুমু খেয়ে একাকার। একটু খোঁচাও অবিশ্যি তপনই মারলো, ‘বিখ্যাত গোয়েন্দা লেখক পদার্পণ করেছেন। বুঝলি তো অভিষেক, বিয়েটা তোর ভাঙবে না। মহাপুরুষের আশিস মাথায় নিয়ে জীবন শুরু করছিস বলে কথা!’
বুঝলাম আমার লেখা এরা পড়ে। যে প্রকাশককে আজকাল বই দিচ্ছি তিনি বহু জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছেন আমাকে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবু অনাবিলভাবেই ভালো লাগলো। এদের সঙ্গে ছেলেবেলার আসল সময়্টা কেটেছে। স্কুল ম্যাগাজিনে জীবনের প্রথম গল্পটা লিখেছিলাম। এরাই আমার প্রথম পাঠক। আজ এরা অনেক দূর থেকে আমার গল্প পড়ছে। আমার সাফল্যে এরা খুশি এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।
অবিশ্যি আজও মনে আছে আমার সেই প্রথম গল্প পড়ে অংশুমান দত্ত নামক কিশোরটির প্রতিক্রিয়া। সেটা শুনে আমি কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি। অংশু বলেছিল গল্পটা আসলে আমার লেখাই নয়, কোন একটা গল্পের বইয়ে নাকি ও সেটা আগেই পড়েছিল। অংশু যেন আমাকে সহ্য করতে পারত না। সবসময় ওরকম গা জ্বালানো কথা বলতে চাইত। গায়ে হাত তুলতে চাইত। ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে একমাত্র ওর বাড়িতে আমি কোনোদিন যাইনি, ও-ও কোনোদিন আসেনি আমাদের বাড়িতে। আমি বুঝে নিয়েছিলাম আমরা বন্ধু নই, এবং সেটা কোনো কারণ ছাড়াই। যদিও পড়াশোনা একই কোচিং ক্লাসে, একই ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট। শুনেছিলাম ওদের খুব বনেদি বাড়ি। জমিদারের বংশ। তখন খুব করুণ অবস্থা। প্রায় খেতে জোটে না বললেই হয়। অংশুকে রিফু করা প্যান্ট পরে রোজ স্কুলে আসতে দেখেছি আমরা। টিফিনে শুকনো মুড়ি চিবোতে দেখেছি।  আমার বাবা এখানে বছর চারেক ছিলেন মহকুমা শাসক হিসেবে। এস ডি ও-র ছেলে হিসেবেই বোধহয় স্কুলে একটু আলাদা নজর পেতাম আমি। অন্য বন্ধুরা সেটাকে আমার প্রাপ্য হিসেবে মেনে নিলেও অংশু হয়তো নেয়নি।
সেই অংশুমানের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। ওকে আর চেনা যাচ্ছে না। অসম্ভব জেল্লা এসেছে চেহারায়। দামি জামাকাপড়।দামি মোবাইল। নিজের বিরাট গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে। বিদেশি সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান মেরেই ফেলে দিচ্ছে । শিলিগুড়িতে ব্যবসা করে শুনলাম এখন। অভিষেক ছিল ওর একমাত্র ক্লাসফ্রেন্ড। তার আমন্ত্রণ নাকি এড়াতে পারেনি, তাই অনেক কাজ ফেলে এসেছে। আমার সঙ্গে আগের তিক্ততা একটুও ওর মনে লেগে নেই বুঝলাম। বেশ আন্তরিকভাবে জড়িয়ে ধরল। আমিই বরং একটু আড়ষ্ট রইলাম। ভুলে যাওয়ার অভ্যাসটা আমার নেই। বিশেষ করে ছেলেবেলার আঘাতগুলো একেবারেই ভুলতে পারি না।
বৌভাত মিটে যাওয়ার পর যখন কলকাতায় ফেরার পালা তখনই এক বিশ্রী ঝামেলা দেখা দিল। এই শহরে কোনোকালেই রেল যোগাযোগ নেই। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম সরকারি ও বেসরকারি বাস। বাসে চেপে তেতাল্লিশ কিলোমিটার দূরের একটি স্টেশনে গিয়ে কলকাতাগামী ট্রেন ধরতে হয়। নাহলে সরাসরি বাসেই হাওড়া পৌঁছনো যায়। সাড়ে চার ঘন্টা মতো লাগে। দুটো রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেল কারণ একটি সংগঠন বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, সেটাও আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য। এখন কলকাতা ফিরতে হলে কোনো গাড়ি ভাড়া করতে হবে। সেটা বিস্তর খরচের ধাক্কা। এদিকে আমার কলকাতা না ফিরলেই নয়। একটা গল্প সময়ের মধ্যে শেষ করে জমা দেওয়ার ব্যাপার আছে। ওস্তাদি করে ল্যাপটপটা কলকাতায় রেখে এসেছিলাম কয়েকদিন নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাবো বলে। এখন বোঝো ঠ্যালা!
সমস্যাটার সমাধান অলৌকিকভাবেই হয়ে গেল। অংশুমান নাকি কলকাতা হয়েই শিলিগুড়ি ফিরবে। ব্যাপারটা বুঝে আমাকে নিজের থেকেই লিফট দিতে চাইলো। আমার দ্বিধা দেখে বেশ ঝরঝরে একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘আরে চল ইয়ার! সেই ছেলেবেলায় কী সব হয়েছিল, তুই কি এখনও সেসব মনে করে রেখেছিস নাকি?’
       বুঝলাম অংশু নিজে কিছু ভোলেনি। আমি অপ্রতিভ হয়ে বললাম, ‘তোর কি মনে হচ্ছে আমি সেসব নিয়ে ভাবছি?’
       ‘আরে ইয়ার, তুই লেখক হতে পারিস, আমি কিন্তু বিজনেসম্যান। মানুষ নিয়েই কারবার আমার। তুই যে একবারও আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিস না সেটা কি আমি লক্ষ্য করিনি ভাবছিস? চল চল, তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যদি একটু প্রায়শ্চিত্ত করা যায় ছেলেবেলার পাপগুলোর। আমিও ওগুলো ভুলিনি জানিস তো, ভাবলে আজ খুব খারাপ লাগে। তুই তো খুব ভালো ছেলেই ছিলি। আমিই শালা চিরকালের স্কাউন্ড্রেল। তখন ছিলাম, এখনও আছি। আসলে বংশের দোষ, বুঝলি তো? রক্ত খারাপ।’
       শেষ পর্যন্ত ছেলেবেলার শত্রুর আরামদায়ক গাড়ি্টিতে তার পাশেই সওয়ার হতে হয়েছে। একেই বোধহয় ইংরেজিতে আইরনি বলে।
       অস্বস্তিটা অবিশ্যি অল্পক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল। সুন্দর ব্যবহার করছিল অংশুমান। ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা বলছিল। আমার নিজেরই বরং খারাপ লাগছিল। সেই কবেকার ছেলেবেলার কিছু ব্যাপার মাথায় পুষে রেখে এই চারটে দিন আমি একমাত্র ওর সঙ্গেই  সহজ হতে পারিনি। এমনকি বৌভাতে ওর পাশে বসে খাওয়াকেও এড়িয়ে গিয়েছিলাম সুকৌশলে। সেটাও হয়ত টের পেয়েছে এই দুনিয়াদার যুবকটি। আমার ইচ্ছে করছিল অংশুকে সরি বলে নিতে। আমরা তো দুজনেই আর সেই ছেলেবেলার মানুষ নই। বোকার মতো আচরণ করেছি আমি। অবিশ্যি কিছু করার ছিল না। অংশুমান যে বদলে গেছে, আমি বুঝবো কী করে! আগের কথাগুলো আমি যেমন ভুলিনি, ও-ও তো ভোলেনি। আমার চেয়ে বেশি করে ও হয়তো সেগুলো মন থেকে মুছে ফেলতে চায়।
       অংশু বলল, ‘তোর কিছু গল্প কিন্তু আমি পড়েছি। গোয়েন্দা গল্প ভালো লিখিস তুই। আমার বৌয়ের কাছে তোর লেখা কয়েকটা বই আছে। আমি সবগুলো পড়ার সময় পাইনি। কিছু পড়েছি। বেশ লেগেছে।’
       আমি হাসলাম, ‘বন্ধুরা লেখা পড়ছে ভাবলে ভালো লাগে।’
       অংশুও হাসল, ‘তোর গোয়েন্দার আইডিয়াখানা কিন্তু মজার। মহিলা গোয়েন্দা। বেশ অন্যরকম। তুই ছাড়া আর কোনো লেখক বোধহয় মেয়ে গোয়েন্দার কথা ভাবেনি, তাই না?’
       ‘না না , তা কেন! ঢের আগে আগাথা ক্রিস্টি ভেবেছেন । আমাদের এখানেও ...’
       ‘সে হোক। আমার কিন্তু তোর মেয়ে গোয়েন্দাকে দারুণ লেগেছে। নামটাও ফাটাফাটি ভেবেছিস – পাপিয়া পুরকায়স্থ। একদম সাদামাটা একটা নাম। কিন্তু কোথায় গিয়ে যেন সেটাই অসাধারণ হয়ে যায়!’
       আমি মজা করে বললাম,‘অনেকে কিন্তু বলে নামটায় পুলিশ-পুলিশ গন্ধ আছে। মেয়ে দারোগার উপযুক্ত নাম। ডিটেকটিভের মতো নাকি ধারালো নয়।’
       ‘ধুস! ভরপুর সেক্স অ্যাপিল আছে নামটায়। সেই সঙ্গে তেজ। মুখে নিলে মনে হয় জিভ চিরে রক্ত পড়ছে।’
       মনে মনে খুশি হলাম। এই প্রথম দেখলাম সাহিত্যের চেনাশোনা বৃত্তের বাইরে একজন আমার তৈরি করা একটা চরিত্রকে ঠিক আমারই চোখ থেকে দেখতে চাইছে। অবাক লাগছিল। অংশু ব্যবসা করে। পড়াশোনা কতদূর করতে পেরেছে? সেটা অবিশ্যি জিজ্ঞাসা করা মুশকিল। যতই বদলে যাক, মানুষ তার ছেলেবেলা থেকে পুরোপুরি আলাদা হয় না। এই প্রশ্ন পুরনো অংশুমান দত্তকে কিছুটা হলেও জাগিয়ে তুলতে পারে। সেটা চরম অস্বস্তির ব্যাপার হবে।
       আমরা এখন ন্যাশনাল হাইওয়ের দিকে এগোচ্ছি। অংশু পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার বেগে গাড়িটা চালাচ্ছে। রাস্তা খুব চওড়া নয়। মাঝেমধ্যে খানাখন্দও আছে। বনধের কারণে আজ কোনো বাস চলছে না। রাস্তা অনেকটাই খালি। মাঝেমধ্যে মালবোঝাই লরি আর ম্যাটাডোর বেরিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিক থেকে। মোটর বাইকের সংখ্যা বেশ ভালোই। তাদের অনেকেই মালবাহক। অনেকে সাইকেলে বোঝা নিয়ে চলেছে। ওতে সবজি আছে বিক্রির জন্য। অনেকের সাইকেলের পিছনে বড়ো হাঁড়ি। ওর মধ্যে আছে মাছ। ওরা কোনো না কোনো স্থানীয় হাটে চলেছে বিক্রির জন্য। এগুলো আমি ছেলেবেলার স্মৃতি থেকেই জানি। খুব কিছু বদলায়নি এই সতেরো বছরে। কিছু গাড়ি যাচ্ছে। অংশুকে ওভারটেক করে কোনো গাড়িকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম না। এই রাস্তায় এর চেয়ে জোরে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। অংশু প্রায়ই সিগারেট ধরাচ্ছে। একটূ টেনেই ফেলে দিচ্ছে। হিন্দি গানের সুর গুনগুন করল কয়েকবার। একবার গাড়ি চালাতে চালাতেই একটা ফোন ধরল, বেশ কিছুক্ষণ হিন্দিতে কথা বলল গতি একটুও না কমিয়েই।
       ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল,‘সরি। তুই কি ভয় পাচ্ছিলি? গাড়ি চালাতে চালাতে কথা বলার অভ্যাস আছে আমার।’
       ‘ভয় পাইনি। কিন্তু এটা কি একটু রিস্কি নয়? মানে দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ?’
       অংশু হো হো করে হেসে উঠল, ‘সেটা ঠিক। তবে কী জানিস তো, রাখে হরি মারে কে?’
       আমিও হেসে বললাম, ‘আর হরি নিজে যদি তোকে একটু শিক্ষা দিতে চান?’
       অংশু আরো জোরে হাসতে শুরু করল,‘এটা খাসা বলেছিস মাইরি! একদম লেখকের মতো কথা বলেছিস। লা জবাব। তবু বলি, জীবন সেই ছোটবেলায় শিখিয়ে দিয়েছে – মারে হরি রাখে কে?’
       আমি জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম অংশু কী ব্যবসা করে শিলিগুড়িতে, কিন্তু তার আগেই অংশু প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, তুই যে এইসব রহস্যকাহিনি লিখিস, এগুলোর প্লট পাস কোথা থেকে? মানে সবই কি কল্পনা, নাকি বাস্তব ঘটনাও কিছু কিছু ব্যবহার করিস? এই ধর টিভি বা খবরের কাগজে যেসব খবর পাই আমরা রোজ, সেগুলোও কি কাজে লাগে? কিংবা নিজের চোখে দেখা কোনো ব্যাপার, বা কোনো বন্ধুবান্ধবের মুখে শোনা কিছু?’
       এই প্রশ্ন আমাকে অনেকেই করেছে। যেকোনো গোয়েন্দা লেখককেই হয়তো করা হয়। উত্তরটাও পুরনো। বললাম, ‘এই সবকিছু মিলিয়েই ব্যাপারটা হয়। মালমশলা সংগ্রহ করাটাই আস। ওটা হাতে এসে গেলে গল্পটা একরকম দাঁড়িয়ে যায়। শুধু লিখে ফেলাটা বাকি থাকে।’
       ‘মানে সব সময় তোদের খোরাকের সন্ধানে থাকতে হয়? কখন কোথায় কী পেয়ে যাস, সব সময় চোখকান খোলা রাখতে হয়?’
       আমি হাসলাম, ‘প্রায় তাই। তোর যেমন ব্যবসায় একটা টেন্ডার , আমাদের একটা নতুন প্লট।’
       ‘বুঝেছি। শান্তি কোথাও নেই। তবে তুই যে লেখক আর ব্যবসাদারকে একই লাইনে বসিয়ে দিলি, এটা বেশ মজার মনে হল। অতটা নিশ্চয়ই নয়?’
       অংশু হাসছিল। আমিও হাসলাম, ‘না, অতটা নয়। আমি বোঝানোর জন্যই বললাম। তবে আমরা তো মামুলি গোয়েন্দা গল্প লিখি। বিক্রি যতই হোক, এই ধরণের বাজারি খুব কম গল্প-উপন্যাস আজ অবধি উঁচু দরের সাহিত্য হতে পেরেছে। লেখকদের মধ্যে আমাদের জাতে ওঠা মুশকিল। তোর সঙ্গে আমার একটা দিক থেকে খুব একটা পার্থক্য নেই। তুই কোনোদিন বিড়লা বা অম্বানী হবি না। আমি কোনোদিন জ্ঞানপীঠ পাবো না, মার্কেস বা বর্হেস হতে পারব না।’
       ‘আমি বুঝে নিলাম। তাহলে একটা কথা বলি স্বপনকুমার?’
       ‘কী?’
       ‘গাড়িটা থামাচ্ছি। ওই দোকানে একটু চা খাওয়া যাক? আমি আগে খেয়েছি। দারুণ চা করে বুড়ো লোকটা। দোকান দেখে সেটা টের পাবি না।’
       অভিষেক আমাদের না খেয়ে আসতে দেয়নি। ভরপেট খেয়েছি এখনও একঘন্টা হয়নি। চা খাওয়ার কোনো তাগিদ ছিল না। কিন্তু না বলতে ইচ্ছে করল না।
       অংশু গাড়ি থেকে নেমে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তারপর হেসে বলল, ‘এবং চা খেতে খেতে আমি হয়তো তোকে একটা টেন্ডার দিতে পারি। মানে যেটাকে আমি এতদিন প্লট ভাবতাম।’
       আমি হাসলাম, ‘তাই নাকি?’
       ‘একদম। এটুকু বলতে পারি সেটা থেকে একটা দুর্দান্ত রহস্যকাহিনি তুই খাড়া করতে পারবি। চাস কিনা বল।’
       ‘কেন নয়? নতুন প্লট সব সময় ওয়েলকাম।’
যে জায়গাটায় আমরা নেমেছি সেটা একেবারেই গ্রাম। নির্জন বললেই চলে। জনমানবের দেখা নেই। শুধু দূরে ধানক্ষেতে কাজ করা কিছু মানুষের অবয়ব । পিচরোডের দুপাশেই সেই চোখ ঝলসানো সবুজ ধানক্ষেত। সময়টা আশ্বিনের মাঝামাঝি। শরতের অরুণ আলো তার অঞ্জলি দিচ্ছে আকাশে বাতাসে। আর দিন সাতেক পরেই দুর্গাপুজো আসছে। এই বছর পুজোর সময় আবহাওয়া ভালো থাকবে মনে হচ্ছে।
এরকম নিরিবিলি চায়ের দোকান গাড়িতে যাওয়ার সময় বহুবার চোখে পড়েছে। সেখানে বসে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এটার জন্য অবিশ্যি অংশুকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু এই দোকানটিতে বসার কথা মনে থেকে যাবে। বিরাট এক অশ্বত্থ গাছের তলায় দোকান। মাটির জীর্ণ দেওয়াল, কালচে খড়ের চাল, দোকানে ঢোকার দরজাটি বাঁশের। আমরা বাইরে গাছের ছায়ায় বসলাম। বাঁশ দিয়েই বানানো এক বেঞ্চি। সেটাতে প্রতিদিন বসার কথা হয়তো কল্পনা করতেই পারি না, কিন্তু এই একদিন বসতে পেরে মন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল। রহস্য নিয়ে কারবার না করে যদি কবিতা লিখতাম, হয়তো জীবনের এই উপরি পাওনাগুলো লেখার কাজে লেগে যেত। বাজারের বদলে যদি সত্যিই সাহিত্যের কথা ভাবতাম... হয়তো আমার সেই সাধ্য ছিল, সাধে কুলোল না। স্বপনকুমার বলে ডাকল আমাকে অংশু। স্বপনকুমার নামক লেখকটির দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিলাম। লেখক স্বপনকুমার আর জ্যোতিষী শ্রীভৃগু আসলে একই লোক ছিলেন। খুব কম লোক সেটা জানে। এমনিতেও, আজ স্বপনকুমারের নাম আর কজন মনে রেখেছে!
দুটো চা করতে বলে অংশু আমার পাশে এসে বসল। হাতে আবার নতুন একটা সিগারেট। বলল, ‘ভালো লাগছে না জায়গাটা? বুঝতে পারছি তোর ভালো লাগছে। কী জানিস তো, এসব জায়গায় তোর একদিন-দুদিন বেশ ভালোই লাগবে, তারপর দম আটকে আসবে। শহর ছেড়ে থাকার কথা ভাবতে পারিস তুই আর?’
‘সেটা ঠিকই বলেছিস। আজ আর পারি না।’
‘হ্যাঁ। আচ্ছা, তুই ড্রিংক তো করিস, সিগারেট খাস না কেন? একা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি। কেমন অপরাধী অপরাধী লাগছে।’
এই কথার কী উত্তর দেবো, বুঝতে পারলাম না। ওকে সিগারেট কমানোর পরামর্শ দেওয়া যেত হয়তো।  তার বদলে বললাম, ‘তুই কী প্লটের কথা বলছিলি তখন? কিছু ঘটেছে তোর দেখার মধ্যে?’
অংশু চুপ করে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। এই সিগারেটটা দেখলাম ফেলছে না। হয়তো খেয়াল না করেই টানগুলো দিচ্ছে। এর মধ্যে চা এল। বুড়ো লোকটি ওর দিকে গ্লাস এগিয়ে দিতে অংশু সচকিত হল। সিগারেট ফেলে গ্লাসটা নিল। চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকাল । বলল, ‘ভালো চা না? কতটা দুধ দিয়েছে দেখেছিস? কলকাতায় এই চা পাবি না।’
‘সেটা ঠিক। তবে আমাদের বাড়িতে গোরুর দুধের চা-ই হয়।‘
আমি ঠাট্টা করিনি। কিন্তু অংশু হেসে উঠল। মজা করার ভঙ্গীতে বলল, ‘খাঁটি চা না খেলে খাঁটি রহস্যের গল্প লিখবি কী করে? তাই না?’
এই কথারও উত্তর নেই। শুধু হাসলাম।
অংশু একটা লম্বা চুমুক দিয়ে চা শেষ করল। আরেকটা সিগারেট ধরাল। গম্ভীর মুখে বলল, ‘আমার দেখার মধ্যে কেবল নয়, আমার জীবনেই ব্যাপারটা ঘটেছে। বলতে পারিস আমার পারিবারিক ঘটনা। পরিবারের সম্মান জড়িয়ে আছে।’
‘তাহলে বলিস না। বলাটা হয়তো ঠিক হবে না।’
‘না। তোকে বলাই যায়। তুই এখন আমাদের চেয়ে অনেক দূরের মানুষ। কাছের লোক আর দূরের লোককে গোপন কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। মাঝের লোকদের নিয়েই গেরো। এই তোর সঙ্গে দেখা হল, জীবনে আর হয়তো হবে না।’
কিন্তু আমি তো এটা লেখায় ব্যবহার করতে পারি
‘পারিস। ব্যবহার করতেই তো বলছি তোকে। তুই নিশ্চয়ই নাম ঠিকানা বদলেই সেটা করবি। তাছাড়া ওই শহরে অনেকেই জানে ঘটনাটা। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে তো সকলেই জানে মনে হয়। হতে পারে একমাত্র তুইই জানিস না। আসলে তোর বাবার বদলির পরের বছর ব্যাপারটা শুরু হয়। তুই তখন শহরে থাকলে তুইও জানতিস। কাজেই লুকিয়ে রাখার কোনো কারণ নেই। তবে গল্পে লিখলে ডিটেলসগুলো একটু বুঝেশুনে লিখিস। ওয়াটসন যেমন করত আর কি...
‘সেই ব্যাপারে কথা দিচ্ছি। তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস।’
‘বেশ। তাহলে শোন। চাইলে নোটও রাখতে পারিস। একটু দ্রুতই বলছি। তোর আমার দুজনেরই তো তাড়া আছে। আমার দিদিকে তোর মনে নেই নিশ্চয়ই? মনে থাকার কথা নয়, কারণ আমার বাড়িতে তুই কোনোদিন আসিসনি। দিদি আমার চেয়ে চার বছরের বড়ো ছিল। রক্তের দোষ যেটা বললাম, বা হরমোনের গোলমাল, ওর মধ্যে আমার চেয়েও হয়তো একটু বেশিই ছিল। অল্প বয়সেই বখে গিয়েছিল একদম। স্কুলে থাকতে প্রথম প্রেম করে। সেটা বাড়ির লোক চাপা দেয় কোনোরকমে। কলেজে যাওয়ার পরে আসল কেলেঙ্কারিটা ঘটাল। সেটা আর রক্ষা করা গেল না। তোর নিশ্চয়ই দেবেশ মল্লিককে মনে আছে?’
আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আবছা মনে আছে। দু-একবার দেখেছি্লাম। দেখলেই ভয় করত। বাবার মুখে অনেকবার নাম শুনেছিলাম। কয়েকটা কেসে নাকি ওর নাম ছিল। খুনও বোধহয় করেছিল কাউকে। কিন্তু কোনোটারই প্রমাণ ছিল না। ’
‘দিদি যখন ফার্স্ট ইয়ারের মাঝামাঝি, দেবেশ মল্লিক ওকে নিয়ে পালাল।’
অংশু এমন সহজ সুরে কথাটা বলে ফেলল, আমি সত্যিই চমকে উঠলাম, ‘বলিস কী? দেবেশ মল্লিকের বয়স তো অনেক বেশি ছিল!’
‘হ্যাঁ। দিদির চেয়ে কুড়ি বছরের বড়ো তো হবেই। কী করে ব্যাপারটা হল , আমরা সত্যিই বুঝতে পারিনি। ও কিন্তু দিদিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যায়নি। দিদি বাড়ি ছাড়ার আগে একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল। তবু পুলিশে জানানো হল। পুলিশ কিছু করতে পারল না। হতে পারে করল না। দেবেশ মল্লিক স্থানীয় এম এল এ-র ডান হাত ছিল তখন।’
‘ভাবা যাচ্ছে না। তবে এরকম ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। এই ধরনের আকর্ষণ দেখা যায়। কিছু ভালো বাড়ির মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায় এভাবেই।’
‘আর সেই যে বললাম – রক্তের দোষ। হরমোন। সেটা তো কথা বলবেই, তাই না? আমাদের বংশটা তো এসব ব্যাপারে কোনকালেই ভালো নয়। একমাত্র আমার বাবা ছিল ব্যতিক্রম।’
অংশু উঠে গিয়ে চায়ের দাম মেটাল। আবার আমরা গাড়িতে উঠলাম। অংশু নাকি গাড়িটা কলকাতা অবধিই চালিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে ওর ড্রাইভার ওর জন্য অপেক্ষা করবে। সে চালিয়ে নিয়ে যাবে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। আজ রাতের মধ্যে শিলিগুড়ি ঢুকতে না পারলে ওর নাকি বড়ো একটা লোকসান হবে। ড্রাইভার কলকাতারই লোক। অংশু এই কয়েকটা দিন তাকে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর একটা সুযোগ দিয়েছে। আসলে গাড়ি চালাতে ওর ভালো লাগে। সেটা যে লাগে বোঝাই যাচ্ছে।
গাড়ি স্টার্ট করে যথারীতি আবার একটা সিগারেট ধরাল অংশু। তারপর বলল, ‘দিদি চলে যাওয়ার আগে থেকেই আমাদের পারিবারিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তোরা হয়তো কিছুটা জানতিস, নামেই জমিদারের বংশ, আসলে দাদুর আমল থেকেই ওই একটা বিরাট বাড়ি ছাড়া আমাদের কিছু ছিল না। কলকাতার দোকান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় দাদু। সেই টাকা ব্যাংকে রাখা ছিল। তখন সেটা ফুরিয়ে এসেছে। গ্রামের দিকে ছিটেফোঁটা কিছু জমি তখনও ছিল। সে বলার মতো কিছু নয়। খেতে না জোটার মতো অবস্থা দাঁড়িয়েছিল বলতে গেলে। বাবার মোটামুটি অল্প বয়সেই একটা সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল তার উপর। কোনো ভারি কাজ বাবা করতে পারত না। মায়ের তো বাড়ির বাইরের দুনি্যা সম্পর্কে কোনোকালেই কোনো ধারণা নেই। দিদি ওই কাজটা করে কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়ে গেল। দিদির আর দেবেশ মল্লিকের কোনো খোঁজ মিলল না প্রায় মাস ছয়েক। বাবা আমার চেয়ে দিদিকেই বেশি ভালোবাসত। চার মাস কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় স্ট্রোকটা হল। এবার আর বাবাকে রাখা গেল না। তবে কলকাতার নার্সিংহোম আমাদের ব্যাংকে জমানো সব টাকা শেষ করে দিলো। আমরা মা-ছেলে পড়লাম অথৈ জলে। মাকে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়ার। সেটা হলে বেশ কিছু টাকা হাতে আসতে পারত। কিছু করা যেত। কিন্তু মায়ের সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না। একটা বিরাট বাড়িতে আমরা দুটি প্রাণী আধপেটা খেয়ে বেঁচে ছিলাম। নিজেদের কেমন ভূতের মতো মনে হতো। এর মধ্যেই দিদি ফিরে এল।’
‘আর দেবেশ মল্লিক?’
‘দেবেশ মল্লিককে সঙ্গে নিয়েই ফিরে এল। আমাদের বাড়িতেই এল। থেকে গেল আমাদের সঙ্গেই দুজনে। দেবেশের তো কোনো চালচুলো ছিল না। মা থাকতে দিল, কিন্তু দিদির সঙ্গে একটা কথাও বলল না। দেবেশ অবশ্য খুব ভালো ব্যবহার করছিল আমাদের সঙ্গে। আমাদের খাওয়া-পরার চিন্তা আর ছিল না। এই কয়েক মাস নাকি ওরা আরবে ছিল। সেখানে দেবেশ অনেক টাকা করেছে। এই কয়েক মাসে অনেক টাকা কী করে করা যায়, আমার তখন কোনো ধারণা ছিল না। কেমন ম্যাজিকের মতো মনে হল। দেখলাম দিদি খুব সুখী। আমার তো লোকটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। তখন আমার ক্লাস ইলেভেন। লোকটার চেহারা ছিল ভালো। কথাবার্তায় চৌকশ। আমার সঙ্গে বড়োদের মতোই আচরণ করত। আমাকে বলত ওর সঙ্গে রাজনৈতিক মিছিলে যেতে , বলত একবার আরবে যেতে। আমার লোভ হত। বলতে পারিস সেই থেকেই আমার ব্যবসার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। এমনিতেই বুঝে নিয়েছিলাম লেখাপড়া করে খুব বেশি কিছু আমি করে উঠতে পারব না।’
গাড়ি জাতীয় সড়কে উঠল। সাধারণ বাসরাস্তা ছাড়িয়ে এই ধরনের প্রশস্ত রাস্তায় উঠলে মনে হয় যেন এক অন্য জগতে এসে পড়লাম। এখানে গতি অনেক বেশি। রোদ-বাতাস অনেক বেশি। গাড়িগুলো যেন এইসব রাস্তার জন্যই অপেক্ষা করে থাকে। অংশু গতি বেশ বাড়িয়ে দিল। এখানেও বাস চলছে না। আজ জ্যাম হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কলকাতায় পৌঁছতে আর ঘন্টাখানেক লাগবে। ঘড়ির কাঁটা বারোটা পেরিয়েছে।
অংশু বলছিল, ‘এইভাবেই বেশ কিছু দিন কেটে গেল। দেবেশ মল্লিকের টাকায় আমাদের সংসার চলছিল। মা অবশ্য ওকে একটা হিংস্র জন্তুর মতোই ভয় করত। আমার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠতা আটকাতে চেষ্টাও করত সাধ্যমতো। কিন্তু কোনকালেই মা জোর গলায় কোনো কথা বলতে পারেনি জীবনে। আর তখন তো তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। দিদি বেশ খুশি হয়েছিল আমাদের সম্পর্কে। বরের প্রতি দিদির আস্থা বা ভালোবাসা কমতে দেখিনি একবারের জন্যও। কাজেই কোনো সমস্যা ছিল না। দেবেশ মল্লিকই ছিল তখন আমাদের বাড়ির কর্তা। এইভাবেই হয়তো চলত, কিন্তু একটা ঘটনা সব ওলটপালট করে দিল। একদিন গভীর রাতে আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখি দিদি আর দেবেশ। দেবেশের জামাকাপড় রক্তাক্ত। দিদির মুখ কাগজের মতো সাদা। দেবেশ আমার হাতে অল্প কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল সে চলে যাচ্ছে, কিছুদিন পরে ফিরবে। বলল আমি যেন দিদির দেখাশোনা করি। আর – একটা মস্ত ছোরা দিয়ে বলল সেটা যেন তখনই কোথাও লুকিয়ে ফেলি। বলেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। দিদি তখনই বসে পড়ে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। আমি কাঁপতে কাঁপতে বুঝলাম প্রথমে যেটা ভেবেছিলাম সেটা নয়, ওটা দেবেশের নয়, অন্য কারও রক্ত। দেবেশ মল্লিক আবার একটা খুন করেছে। পরের দিন জেনেছিলাম সেটা ছিল রাজনৈতিক খুন। দলের একটি কাঁটাকে সে সরিয়ে দিয়েছিল।’
গাড়ির গতি এখন আশির উপর। কাচের মতো রাস্তা। অংশুর দামি গাড়িতে একটুও ঝাঁকুনি টের পাওয়া যায় না এমনিতেই। দুপাশের দৃশ্য হু হু করে ছুটে যাচ্ছে। অংশু অনেকক্ষণ সিগারেট ধরায়নি দেখছি। হয়তো খেয়াল করেনি। সিগারেটের প্রতি ওর নেশা কতটা কে জানে, মনে হয় যেন ধরানোতেই আনন্দ। নাহলে অত অল্প কয়েকটা টানেই একটা প্রায় আস্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা কেউ ধরিয়ে নেয় না।
অংশু বলল, ‘সিনেমার মতো মনে হচ্ছে না ঘটনাগুলো?’
আমি বললাম, ‘সিনেমা তো জীবনের বাইরে নয়। হয়তো জীবনের চেয়ে একটু বড়ো মনে হয়, তবে মাঝেমাঝে জীবন আরো অবাক করে দেয়। তারপরে বল। তোর তো তাড়া আছে। কলকাতা এসে পড়ল।’
‘শুরু যখন করেছি, তোকে পুরো ঘটনা না শুনিয়ে চলে যাওয়ার মতো তাড়া নেই। যাক, তারপর শোন। পরের দিন পুলিশ এল। আমি অবিশ্যি রাতেই ছোরাটা আমাদের বাড়ির পিছনে বিরাট বাগানে একটা বুড়ো আমগাছের কোটরে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। আজও ভেবে পাই না দেবেশ ওটাকে আমাদের বাড়ি আসার আগেই কোথাও লোপাট করে দেয়নি কেন! দেখেছিলাম ওটার হাতলে খোদাই করে লেখা ছিল ‘ডি’ আর ‘এম’। অনেক জায়গায় রক্তও লেগেছিল। ধোয়ার সাহস হয়নি। তবে ওটার খোঁজ কেউ পাবে না জানতাম। দিদি আর আমিই একমাত্র কোটরটার হদিশ জানতাম ছোটবেলা থেকে। সেটাই হল। পুলিশ সারা বাড়ি লন্ডভন্ড করে কিছু না পেয়ে চলে গেল। সদর দরজাতেই দেবেশের রক্তমাখা হাতের একটু ছাপ লেগেছিল। সেটাও ওরা লক্ষ্য করল না। সেই প্রথম দত্তবাড়িতে পুলিশ এল। মা খুব ভেঙে পড়েছিল। আমার উচ্চ মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল। আমি আর বাড়ি থেকে বেরোতাম না। বাধ্য হয়ে বেরোলেও ক্লাসের ছেলেদের দেখলে মুখ লুকিয়ে পালাতাম। একমাত্র অভিষেকের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। দিদিকে তো চেনাই যাচ্ছিল না ওই এক রাতের পরে। দিদির মাথাটাই কেমন বিগড়ে গেল। কোনো পুরুষকে একটি মেয়ে এত ভালোবাসতে পারে, আমি দিদিকে না দেখলে জীবনে বিশ্বাস করতে পারতাম না। অসম্ভব রোগা হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিল বললেই হয় । দাঁত মাজত না। নখ কাটত না। স্নান করত না। ওর দিকে তাকাতে ভয় হত। আমি ওকে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু দেখলাম মা ওর যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করছে। দিদির প্রতি পুরনো রাগ মা ভুলে গিয়েছিল। আশ্চর্য ব্যাপার না?’
আমি বললাম, ‘সেটাই তো হওয়ার কথা। হাজার হোক সন্তান তো!’
‘হ্যাঁ। মায়ের জন্যই অবিশ্যি দিদি বেঁচে গেল। তবে দেখতে দেখতে ওর মাথাটা খারাপই হয়ে গেল। তুই একবার ভেবে দেখ আমাদের তখনকার অবস্থা। ওরকম অবস্থাতেই হয়ত লোকে আত্মহত্যার কথা ভাবে। হয়তো বাড়ির সকলে মিলে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজ সেটা মনে হয়। তখন কিন্তু ভাবিনি। আমার মন খুব শক্ত হয়ে গিয়েছিল। যে করেই হোক উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিতেই হবে ঠিক করে নিয়েছিলাম। তারপরে অবিশ্যি কলেজে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। হয়তো কিছু রোজগারের উপায় দেখতে হবে এরকমই ভেবেছিলাম। হয়তো একটা ছোটখাটো দোকান, যেটা আমাদের বাবা অনেকবার করবে ভেবেও করতে পারেনি। আমার সামনে তখন ওই একটাই পথ ছিল। একটা ছোট ব্যবসা।’
‘তোর মনের জোর যে আছে সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। সম্পূর্ণ নিজের ভরসায় তুই আজ এতখানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিস। খুব অল্প লোক সেটা পারে।’
অংশু এতক্ষণে আবার একটা সিগারেট ধরাল। হাল্কা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘আসলে পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যে আমার শক্ত না হয়ে উপায় ছিল না। আমাদের দুর্ভাগ্য তো ওখানেই শেষ হল না, আরো কিছু বাকি ছিল।’
‘কী রকম? দেবেশ মল্লিক আবার ফিরে এল?’
‘দেবেশ মল্লিকের সঙ্গে আমাদের আর জীবনে দেখা হয়নি। এর মধ্যেই আমার উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে গেছে। পরীক্ষা দিয়েই মাকে বলেছি আমি ব্যবসা করতে চাই। বলেছি বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। মা ভরসা পেল না। সেটা স্বাভাবিক। তখন আমার আঠারো বছর বয়স। ওইটুকু ছেলের উপর কে ভরসা করবে! বাড়ি চলে গেলে আমাদের হাতে আর কিছুই থাকবে না। আমি মাকে দোষ দিলাম না। লোনের খোঁজ নিলাম। দেখলাম সেটা আমার পক্ষে একেবারেই সহজ পথ নয়। এতদিনে পুরোপুরি দিশাহারা লাগছিল। কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাড়ির অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হচ্ছে। দিদিকে কোনো পাগলের ডাক্তার দেখানো হবে কিনা সেটা ভাবার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেক কষ্টেও মা চোখের জল ফেলত না। এখন কান্নাকাটি করে প্রায়ই। এর মধ্যে একদিন এসে হাজির হল বিশ্বনাথ পাল।
‘সে আবার কে?’
‘সে যে কে ছিল, আমি আজও জানি না। তবে ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বদমাস। নরকের পোকাগুলোও বোধহয় ওর চেয়ে একটু ভালো হয়। চেহারা চাউনি হাবভাবও সেইরকম। একদিন সন্ধেবেলা এল। বলল ও নাকি দেবেশ মল্লিকের পুরনো বন্ধু। বলল দেবেশ মল্লিক নাকি নদীয়ায় খুন হয়ে গেছে অন্য পার্টির গুন্ডাদের হাতে, আর তার লাশ গুম করে দেওয়া হয়েছে। সেটা আবার সরাসরি বলল মা আর দিদির সামনে। দিদি সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল। মা দিদিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বিশ্বনাথ দিদির অবস্থায় বিচলিত তো হলই না, বরং এমনভাবে হাসল যেন বেশ মজা পেয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যা হওয়ার তা তো হয়েছে খোকাবাবু। যে গেছে সে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আমি তো এখনও বেঁচে আছি! আরো বাঁচতে চাই। আমার মালটা এভাবে গাপ করে রাখাটা কি ভালো হচ্ছে তোদের? ওটা এবার তো আমাকে ফিরিয়ে দে!’ আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কোন মালের কথা সে বলছে। বিশ্বনাথ পাল জানাল তার কিছু সোনার বিস্কুট দেবেশ মল্লিকের কাছে ছিল। দেবেশ তাকে বলেছে খুনের পরে সেগুলো আমাদের কাছেই সে লুকিয়ে রেখে গেছে। আমি বললাম সেটা অবাস্তব ব্যাপার। বিশ্বনাথ একটা অশ্রাব্য খিস্তি করে বলল আমি না জানলেও আমার দিদি নিশ্চয়ই জানে। আমি বললাম দিদির মানসিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু বিশ্বনাথ পাল তা শুনতে চাইলো না। নোংরাভাবে কথা বলতে শুরু করল। আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ওকে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দিলাম। লোকটার গায়ে জোর একটুও ছিল না। যাওয়ার আগে অবিশ্যি শাসিয়ে গেল আমাদের দেখে নেবে। এরপর সে রোজই আসতে শুরু করল। কাছেই কোনো একটা লজে আস্তানা নিয়েছিল। সর্বদা বাড়ির উপরে নজর রাখত। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই এসে হাজির হত।’
আমি বললাম, ‘তোরা পুলিশে জানালি না কেন? লোকটা তো ক্রিমিনাল! বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছিলি কেন?’
অংশু হাসল,‘ভুলে যাচ্ছিস ওটা যেমন আমার বাড়ি, ওটা দিদিরও বাড়ি। দেবেশ মল্লিকের শ্বশুরবাড়ি। দিদি লোকটা এলে খুশি হচ্ছিল।’
‘সে কি! কেন?’
‘দিদি ভাবছিল দেবেশ মল্লিক সত্যিই মরেনি। লোকটা মিথ্যে বলছে। লোকটা জানে দেবেশ কোথায় আছে। সেই সন্দেহ আমারও যে হয়নি তা নয়। তবে দিদি মনে হয় ভাবছিল লোকটাকে ফুসলিয়ে আসল খবরটা বের করে নেওয়া যাবে।’ অংশু হাসল, ‘ফুসলানোর ব্যাপারে দিদি তো অদ্বিতীয় ছিল। বিশ্বনাথ পাল আমাদের জীবনে আসার পর থেকে ও বেশ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ফলে মা-ও লোকটাকে ঘাঁটায়নি। কিন্তু একদিন কেলেঙ্কারি হল। জাত সাপকে ঘরে আসতে দিলে সেটা তো হবেই।’
‘কী হল?’
‘বলছি। এটাকে কিন্তু গল্পে ব্যবহার করলে খুব সাবধানে করবি। তোকেই একমাত্র বলছি পৃথিবীতে।’ অংশু আবার সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘একদিন সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে দেখলাম একতলায় কোনো আলো নেই। বুঝলাম বাল্ব কেটে গেছে। দোতলায় উঠলাম। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম দিদির ঘরে আলো জ্বলছে, চাপা গলায় কথাও শোনা যাচ্ছে। দিদির গলা। ভাবলাম মা আর দিদি কথা বলছে। একটা বাল্ব কেনা দরকার। মায়ের কাছেই এসবের টাকা থাকত। আমি গিয়ে দরজা ঠেললাম। ঢোকামাত্র দুটো শরীর ছিটকে আলাদা হয়ে গেল। দিদি কোনোরকমে গায়ে একটা কিছু জড়িয়ে নিয়ে খাটে গিয়ে বসল। বিশ্বনাথ সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় নির্বিকারভাবে আমাকে খিস্তি দেওয়া শুরু করল। তার বক্তব্য আমি ওভাবে ঘরে ঢুকে অন্যায় করেছি। দোষটা আমার। আমার কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে অবশ মনে হচ্ছিল। ওর কথাগুলো কানে ঢোকার পর সারা গা জ্বলে উঠল। হাতের কাছে একটা পেতলের ফুলদানি ছিল। সেটা নিয়েই ছুঁড়ে মারলাম লোকটার মাথা লক্ষ্য করে। লাগল না। তখন তেড়ে গেলাম ওর দিকে। ও বেগতিক বুঝে পায়ে প্যান্ট গলাতে গলাতে দৌড় লাগাল। আমি পিছনে তাড়া করলাম। অন্ধকার সিঁড়িতে পা ফসকে লোকটা গড়াতে গড়াতে একতলায় পড়ল, সেখান থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরের রাস্তায়। আমিও পিছনে গেলাম। ওকে অনুসরণ করে গিয়ে ওর লজটা দেখলাম। ঠিক করলাম পরের দিন সকালে অপেক্ষা করে থাকব। ও বেরোলেই ঠ্যাঙাব। ওকে শহর থেকে তাড়িয়ে ছাড়ব। কিছুক্ষণ পরে বাড়ি এসে দেখলাম মা দিদির ঘরে বসে আছে। বুঝলাম বাইরে কোথাও গিয়েছিল। ফিরে এসে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে। মেঝেতে বিশ্বনাথের কিছু পোশাক তখনও পড়ে ছিল। দিদি ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। মা আমার দিকে যে চোখে তাকাল তা আগে কখনও দেখিনি। মাকে এই প্রথম এতখানি রাগতে দেখলাম। আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এল। আমার ঘরে এসে বসল। সোজা জিজ্ঞাসা করল বিশ্বনাথ পালের আস্তানা আমি জানি কিনা। আমি হ্যাঁ বলতে বলল পরের দিন সকালে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ওই লজে যাবে, এবং একটা হেস্তনেস্ত করবে। যদি বিশ্বনাথ আমাদের মুক্তি না দেয় পুলিশকে জানাবে।’
অংশু গাড়ি থামাল। সিগারেটটা ফেলে বলল, ‘চল একটু নামি। কলকাতা পৌঁছতে আর আধঘন্টাও লাগবে না। তোর খুব তাড়া নেই তো? খুব একটা বাকি নেই। মাটিতে পা রেখে বাকি ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে। তুইও মাটিতে থেকে শোন।’
‘বেশ বলেছিস তো! তবে তুই আজ যা শোনালি, উপন্যাস হার মেনে যায়।’
‘উপন্যাসটা তো এবার লেখা হবে। তুই লিখবি ইয়ার।’
আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। বেলা দেড়টা বাজে। রোদ বেশ চড়া। জাতীয় সড়কে গাড়ির ভিড় এই সময় কম থাকে। আজ আরো কম। আমরা একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম। সামনে একটা জলামতো জায়গা। অনেক নলখাগড়া হয়ে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখেই হয়তো অংশু গাড়ি থামিয়েছে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল ও। সিগারেট শেষ। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘বাকি আখ্যান কোনোরকম ধোঁয়া ছাড়াই আপনার সামনে পেশ করা হচ্ছে জাঁহাপনা। সেই রাতটা তো না ঘুমিয়েই কেটে গেল। ভোরের আলো একটু ফুটতেই আমরা মা-ব্যাটা বেরোলাম। লজের কাছাকাছি এসে দেখলাম এর মধ্যেই সেখানে একটা জটলা তৈরি হয়েছে। খুব হইচই হচ্ছে। আমাদের কেমন যেন ভয় করল। ভাবছিলাম পালিয়ে আসব। তার আগেই ভিড় থেকে কয়েকজন এগিয়ে এল। মাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘জামাই তো আবার কাজ করেছে! আবার একটা মানুষকে মেরেছে।’ আমরা বুঝতে পারছিলাম না কিছু। ওরাই বলল লজের বারান্দায় একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে। বুকে গেঁথে আছে একটা বিরাট ছোরা। মা কোনোরকমে প্রশ্ন করল, ‘সে এই কাজ করেছে তোমরা জানলে কী করে?’ ওরা বলল ছোরাটা পরিচিত। ওই ছোরা নাচিয়ে নাচিয়েই নাকি দেবেশ মল্লিক যত রাজনৈতিক কুকর্ম করে বেড়াত। তাছাড়া ছোরার হাতলে ওর নাম এবং পদবীর আদ্যাক্ষরদুটো লেখা আছে। আমাদের মাথা ঘুরছিল। আমি মাকে ইশারা করলাম। আর এখানে থাকা উচিত হবে না। এর মধ্যেই একজন আমার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘এই ছোকরাও তো কাল সন্ধেবেলায় লোকটাকে তাড়া করে আসছিল। আমি নিজে দেখেছি। কী কেস হে? তোমরা এত ভোরে এখানে কেন?’ মা তাড়াতাড়ি আমাকে আড়াল করল। আমরা কোনোরকমে পালিয়ে এলাম। ছুটতে আরম্ভ করলাম বাড়ির দিকে। বুঝতে পারছিলাম গতকাল সন্ধের ঘটনার পর আমিও পুলিশের সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতে পারি। কিছু লোক আমাকে ওকে তাড়া করতে দেখেছে।’
অংশু একটু থামল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যিই আমার জীবনটা তোর উপন্যাসের চেয়ে বড়ো না?’
‘তাই তো দেখছি! তারপর কী হল?’
‘বাড়ি এসে আগেই ছুটলাম দিদির ঘরে। দিদি নেই। দিদিকে কোথাও দেখতে পেলাম না। দিদি সারা বাড়িতেই কোথাও নেই। দিদিকে আর কোনোদিন দেখতে পাইনি। দিদি সেদিনই আমাদের জীবন থেকে মুছে গেল। মানুষটা যে ছিল আজ বিশ্বাস হয় না জানিস!’
‘বলিস কী! আর পুলিশ?’
‘পুলিশ তো এসেছিল। তার আগে অবিশ্যি আমি বাগানে গেলাম। ছোরাটা আছে কিনা দেখার জন্য হাত ঢোকালাম গাছের কোটরে। একটা ধাতুর ছোঁয়া পেলাম বটে, তবে সেটা ছোরা নয়। সেই ছোরাটাও দিদির মতোই উবে গিয়েছিল।’
‘তবে?’
‘স্টিল নয়। সোনার ছোঁয়া লাগল হাতে। দু-দুটো সোনার বিস্কুট রাখা ছিল কোটরটার মধ্যে। আমি সেগুলো আবার যথাস্থানে রেখে দিলাম। ওখানেই থাকল যতদিন না পুলিশের ঝামেলা মেটে। পুলিশ কয়েকবার বাড়িতে এসেছিল। তবে আমাকে সন্দেহ করেনি। ওরা নিশ্চিত ছিল দেবেশ মল্লিক এসে বৌকে নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নিকেশ করে গেছে নিজের একজন শত্রুকে। ছোরাটা পাঁজরের মধ্যে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে ওটাকে আর নিয়ে যেতে পারেনি। হাড় না কেটে ওটাকে বের করে যেত না।’
‘আর সোনার বিস্কুটদুটো? তোকে তোর দিদির উপহার? তোর ব্যবসার ক্যাপিটাল?’
অংশু একটা ছোট ঢেলা তুলে নিল। সেটাকে সামনে দিকে ছুঁড়ে বলল, ‘বলতে পারিস। আবার উপহারটা দেবেশেরও হতে পারে। লোকটা তো আমাকে পছন্দই করত। তবে যদি সে বেঁচে থাকে তখনও ...’
‘তুই নিশ্চয়ই বলতে চাস না তোর পাগল দিদিই ...’ আমার ফোনটা বেজে উঠল। সম্ভবত অন্বেষা ফোন করছে। ওদের ফোন করতে ভুলেই গেছি আজ। ব্যস্ত হয়ে কানে লাগাতেই উল্টোদিক থেকে অভিষেকের পরিচিত গলা শুনলাম, ‘হ্যালো, তুই ঠিক আছিস তো?’
‘কেন?’
‘তুই কি ওর গাড়িতে?’
‘না। কী হয়েছে কী?’
‘ওর থেকে একটু সরে আয়। তোরা তো এখনও কলকাতায় ঢুকিসনি মনে হচ্ছে! কথা আছে তোর সঙ্গে।’
বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে হল কোন গোলমাল হয়েছে। আমি উঠলাম। হাঁটতে হাঁটতে অংশুর চেয়ে বেশ একটু সরে গেলাম। ও আর আমার কথা শুনতে পাবে না। জোরে হাওয়াও বইছে।
অভিষেক চাপা গলায় বলল, ‘অংশু ছেলেটা সুবিধার নয় , বুঝলি! একটু আগে কয়েকজন লোক আমাদের বাড়িতে এসেছিল। বলল সাদা পোশাকের পুলিশ। অংশু সম্পর্কে জানতে চাইল। ওরা মনে হয় এই কয়েকদিন আমাদের বাড়িতে নজরও রাখছিল।’
‘ব্যাপারটা কী?’
‘সেটা খুলে বলল না। স্মাগলিং গোছের কিছু ব্যাপার মনে হয়। দ্যাখ, আমি তো অংশু সম্পর্কে কিছুই জানি না। ও বলেছে ও শিলিগুড়িতে ব্যবসা করে। কী ব্যবসা কিছুই কোনোদিন বলেনি। ও-ই আমাকে ফোন করে। আমি করতে পারিনি একবারও। ঘনঘন নাম্বার বদলে যায় দেখেছি। ছেলেটা আদৌ ঠিকঠাক নয় মনে হচ্ছে। তুই পারলে ওর সঙ্গে আর ফিরিস না। অবশ্য আজ তুই বাস পাবি না।’
‘সেটার কোনো দরকারও মনে হয় নেই। ও আমার ক্ষতি কেন করবে?’
‘তবু সাবধানে থাকিস। হয়তো ওকে ফলো করা হচ্ছে।’
আমি এদিক সেদিক তাকালাম। একটা সাদা গাড়ি অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন লোক নেমেছে। একজন ফোনে কথা বলছে। আমি সেটা অভিষেককে জানাতে ও বলল, ‘তার মানে তোর ফ্ল্যাটেও আজ পুলিশ যেতে পারে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলাম। পেছনে পুলিশ আছে যখন তোর কোনো ভয় নেই।’
‘আমার ভয় কেন থাকবে!’
‘আরে, ছেলেবেলা থেকেই তো তোর প্রতি ওর একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে।’
‘আচ্ছা, একটা ব্যাপার বল তো, অংশুর কোনো দিদি ছিল?’
অভিষেক একটু সময় নিয়ে বলল, ‘না। আমি একসময় প্রায়ই ওর বাড়ি যেতাম। সেই বাড়ি এখন বিক্রি হয়ে গেছে। একটা হোটেল হবে শুনছি। তবে ও বাড়ির একমাত্র ছেলে। দিদি-দাদা-ভাই-বোন কিছুই নেই। কেন?’
‘এমনিই জিজ্ঞাসা করছি। আচ্ছা, আরেকটা কথা, তুই দেবেশ মল্লিক নামে কোনো লোককে চিনিস তোদের ওখানে?’
‘কেন চিনব না! আগে গুন্ডা ছিল। এখন সিমেন্ট-বালির ব্যবসা করে। এখানকার মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলর হয়েছে এখন। আর বলিস না, রাজনীতি দেখলে এখন ঘেন্না ছাড়া কিছু হয় না। কিন্তু তুই এসব জিজ্ঞাসা করছিস কেন?’
‘পরে বলব। অনেক কিছুই বলার আছে।’
ফোন কেটে দিয়ে আমি অংশুর দিকে এগোলাম। ও আঙুল দিয়ে মাটিতে কিছু করছিল। আমাকে দেখে হাসল, ‘প্রকাশকের ফোন? স্টার হয়ে গেছিস মাইরি! এই, তুই তো আমাকে তোর নাম্বার দিলি না!’
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ‘তুই চাইলি কই?’
‘এই তো চাইলাম। এবার দে। বাড়ি ফিরে ফোন করব। বৌ খুব খুশি হবে প্রিয় লেখকের গলা শুনে।’
অংশু কি সত্যিই বিয়ে করেছে? এটাও মিথ্যে হতে পারে। আমি পরপর সংখ্যাগুলো বলতে বলতেই ভাবলাম। এই গাড়িটাও হয়তো ওর নয়। হয়তো অন্য কোনো গাড়িতে শিলিগুড়ি ফিরবে। কিংবা ... আদৌ ও শিলিগুড়ি থেকে আসছে না। ওর নাম্বার চাইতে অংশু মজা করে বলল ও ওভাবে দেবে না। বাড়ি থেকে ফোন করবে। ওর বৌ আমাকে ওর নাম্বার দেবে।
আবার আমরা গাড়িতে উঠলাম। বাতাসে কলকাতার গন্ধ ভারি হতে শুরু করেছে। কলকাতাকে টের পাওয়া যাচ্ছে।
অংশু বলল, ‘তুই তো বললি না কেমন লাগল। লার্জার দ্যান লাইফ মনে হল কি?’
অংশু হাসছিল। আমিও চেষ্টা করে হাসলাম। বললাম, ‘জীবনের চেয়ে বড়ো কি আর কিছু হতে পারে? জীবন থেকেই তো কল্পনা উঠে আসে! গল্পের গোরু যে গাছে ওঠে, তার আগে মাটি থেকেই তো ওঠে! গাছটার শিকড়ও থাকে মাটির মধ্যেই!’
অংশু আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠল, ‘ফাটাফাটি! একদম লেখকের মতো বলেছ বস! গল্পটা তাহলে তোর মনে ধরেছে। তুই তাহলে লিখছিস ওটা। বেশ। জমিয়ে পড়া যাবে নিজের জীবনকাহিনি তোর কলমে।’
ওর হাসির মধ্যেই গাড়িটা দ্বিতীয় হুগলি সেতুতে উঠল। এই জায়গাটায় এসে মনে হয় কলকাতা যেন তার হাতের চেটোয় আমাকে তুলে নিচ্ছে। একটু পরেই আমি জড়িয়ে পড়বো তার স্নায়ুতন্ত্রে। হয়ে উঠব তার খোরাক।
অংশু কি সত্যিই আমাকে ফোন করবে? ও এই মুহূর্তে হয়তো বেশ তৃপ্তি অনুভব করছে। ছেলেবেলার শত্রুকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার তৃপ্তি। হয়তো ভাবছে ও প্রমাণ করে দিল নিজে রহস্যকাহিনি লিখলে আমার চেয়ে কিছু খারাপ লিখত না। ও লিখছে না, তাই আমি করে খাচ্ছি। আমার প্রথম গল্পটা আমার মতোই ও-ও বোধহয় ভোলেনি।
অংশু চাইলেও অবিশ্যি আমাকে ফোন করতে পারবে না। আমি আমার নাম্বারের মধ্যে দুটো সংখ্যা বদলে দিয়েছি। আর কিছু মিনিট পরে হয়তো ওর সঙ্গে আমার আর জীবনে কখনও দেখাও হবে না। তবে ও নিশ্চয়ই বই দোকানে নিয়মিত খোঁজ রাখবে আমার কোনো নতুন বই বেরিয়েছে কিনা।
পিছনে সেই গাড়িটা অনুসরণ করছে কিনা দেখতে চাইলাম। অনেক গাড়ির ভিড়ে চেনা মুশকিল। হয়তো যে কোনো মুহূর্তে সেটা বেরিয়ে এসে আমাদের ওভারটেক করে রাস্তা আটকাবে। হয়তো তখন অংশু একটা পিস্তল বের করবে। হয়তো এই গাড়িতে অনেকগুলো সোনার বিস্কুট লুকোনো আছে। হয়তো তার চেয়েও খারাপ কিছু।
বাইরে থেকে হু হু করে নদীর হাওয়া ঢুকছে। আমি সিটে মাথা রেখে আরাম করে বসলাম।
আমার ভয় করছিল না। খুব হাসি পাচ্ছিল।


                                      
  

         

3 comments:

  1. বেশ ভালো গল্প। অসম্ভব গতি আছে। বিন্যাসও দারুণ লাগল। এই প্রথম আপনার গল্প পড়লাম। পড়েই মুগ্ধ।

    ReplyDelete
  2. পড়লাম। তোমার ভাবনাগুলো মুগ্ধ করে, অবাক হরে। তা কি কবিতা কি গল্পে।

    ReplyDelete